মাটির ঘরখানার ধারে খেজুর গাছেই কে বেঁধে দিয়েছে ভোটের ঝান্ডা। অলস পাড়াগেঁয়ে দুপুর খান-খান করে চক্কর কাটছে প্রচার-গাড়ি। মোটাপানা, গ্যাঁড়া লোকটাকে তাই ইদানীং একটু বেশিই মনে পড়ছে যেন।
দূরে ঝিটকার জঙ্গলের ঝর্নার জল মাথায় বাঁধগড়ার গ্রামে ফিরতে আনমনা হন বিধু সিংহ। বিকেলে কাঁটাপাহাড়ির হাটে জঙ্গলের কাঠ বেচতে গিয়েও সাত-পাঁচ চিন্তা থিকথিক করে। বট-শিমূল-শাল-খেজুর ইতি-উতি তাকালেই চোখে পড়ে এক-একটা ঝান্ডা।
একটাই রং সবার।
দশ বছরে কম ঝান্ডা বদলাতে দেখেননি লালগড়ের কাঁটাপাহাড়ি এলাকার ক্ষয়াটে হাড় জিরজিরে নারী। সিপিএমের কাস্তে-হাতুড়ি, মাওবাদীদের টকটকে লাল ঝান্ডার যুগ শেষে এ হল, তৃণমূলের জোড়া ফুলের জমানা। আর সব ঝান্ডা যেন অজ গ্রামের থম মারা স্মৃতির পেটে ঘুমিয়ে রয়েছে। ‘যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। দিদির সভায় যেও কিন্তু বউদি!’—পাড়াতুতো দেওর তৃণমূলের ডমন মাহাতো পই পই করে বলে গিয়েছিলেন। লালগড়ের সজীব সঙ্ঘের মাঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভা। খাঁ-খাঁ গ্রামে সারা বিকেল তবু মাটির দেওয়ালের ছবিটার দিকে চেয়ে বসেছিলেন বিধু।
যেখানেই যান মমতা এখনও একবার জঙ্গলমহলের ‘হাসি’র কথা বলেন। হাসিমুখে এ তল্লাটে ঘুরে বেড়ানো গোলগাল গ্যাঁড়াপনা লোকটা শুধু দেওয়ালে বাঁধাই ছবির ফ্রেমে ঢুকে বাসা বেঁধেছে।
দশ বছর আগে বেঘোরে খুন হওয়ার সময়ে একটাও ছবি ছিল না লোকটার। ভাগ্যিস, নেগেটিভখানা পাওয়া গেল। লালগড়ের স্টুডিওয় সেটাই বাঁধিয়ে এনেছিলেন স্বামীহারা।
স্বামী বলতে অবশ্য ঠিক ছবির এই মুখটা মেলাতে পারেন না বিধু। বরং ভাবলে, পেপারের প্রথম পাতার ফটোটাই দগদগ করে। জঙ্গলের ধারে পড়ে থাকা শরীর। ধুলোমাখা দু’টো খালি পা আর লাল প্যান্টের আভাস। বড় মেয়ে উমা এখনও বাবার ফটোটা স্কুলের ব্যাগে রেখে দিয়েছে। সারা গায়ে তার জড়ানো দেখে মাওবাদীদের বোমার ভয়ে বডি ছুঁতে পারছিল না পুলিশ। বাঁশ দিয়ে টেনে আনে। পাশের হাড়ুলিয়া গ্রামে রাত শেষে বল খেলার ডাঙার ধারে দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল চেপে সব দেখেছিলেন বিধু।
ময়নাতদন্তের পরে লাশ পৌঁছে দিয়েছিল বাঁধগড়ার মাটির ঘরে। প্রশাসনের ছোঁয়া বলতে সেটুকুই। পিছনের মাঠে ঝপাঝপ পুড়িয়ে সব শেষ। দশ বছর আগের বিধানসভা ভোট ঘোষণা হতেই ঘটনাটি ঘটে। এর পরে কম রক্তপাত দেখেনি জঙ্গলমহল। দিল্লির টাকাও কম ওড়েনি মাওবাদী-প্রভাবিত এলাকায়। যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁদের ঘরের লোক অনেকেই চাকরি বা সাহায্য পেয়েছেন। যাঁরা খুন করেছেন, তাঁদের অনেকের জন্যও পুনর্বাসন প্যাকেজ। চাকরি, ভাতা, নিরাপত্তা...কত কী! কোলের ছেলেমেয়ে দু’টোকে নিয়ে দিন আনি-দিন খাই স্বামীহারার ঘরে সরকারি কল্যাণহস্তের ছোঁয়া মেলেনি।
২০০৬ সালে মাওবাদীদের হাতে খুন হন বাঁধগড়ার কার্তিক সিংহ। মাওবাদীদের হাতে নিহতদের জন্য সরকারি প্যাকেজ ঘোষণা ২০০৭ সালের। কার্তিকের স্ত্রী বিধুর দাবি অতএব কোথাও কল্কে পায়নি। সরকারি আমলারা অসহায়তার কথা বলেন। খুনের অন্যতম অভিযুক্ত লালগড় স্কোয়াডের সুচিত্রা মাহাতো কিন্তু নতুন জীবন পেয়েছেন। বিকাশ, মদন মাহাতোরা পলাতক। কার্তিক খুনের পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতার জমানা— দু’টোই দেখেছে লালগড়। সহাস্য জঙ্গলমহলে বিধু ও তার দুই ছেলেমেয়ের টালমাটাল জীবনযুদ্ধ একই থেকে গিয়েছে।
স্বামীর মৃত্যুদিন, জন্মদিনের বড়লোকি আদিখ্যেতা পোষায় না হতদরিদ্র ঘরে। কবে ঘটনাটা ঘটেছিল, সন-তারিখ মনেও থাকে না বিধুর। ভোটের দামামা তবু পুরনো ভোটের রক্তাক্ত স্মৃতি খুঁচিয়ে তোলে। সে-বারই প্রথম বিধানসভা ভোটে পার্টির কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কার্তিক। ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে ন্যাড়চা বুথ কমিটির কনভেনর। তাতেই কি পুড়ল কপালটা?
বিধুর মনে পড়ে, সন্ধ্যায় পুকুর খোঁড়ার কাজ নিয়ে একটা মিটিংয়ে পাশের হাড়ুলিয়া গ্রামে গিয়েছিলেন কার্তিক। স্বামীর অপেক্ষা করতে করতে কখন চোখটা লেগে যায়! পর দিন সকালে খবরটা পেয়ে ছানা দু’টোকে সঙ্গে নিয়েই ছুটে যান তিনি।
মাওবাদীরা লোকটাকে নিষেধ করেছিল, সিপিএম করবি না! কিন্তু ও তো কোনও নেতা ছিল না। পার্টি থেকে একটা কানাকড়ি কখনও পায়নি। সস্নেহে স্বামীর কথা বলে চলেন বিধু। ‘‘আর কীই বা করবে? মোটাপানা চেহারায় মাটি কাটার ধকল পোষাত না যে! ঘরের কাজ, ক্ষেতের কাজ আমিই সারতাম।’’ গাঁয়ের ছেলে হয়েও সাইকেল সামলাতে পারতেন না কার্তিক। হাড়ুলিয়া, কুমারবাঁধ, বাঁধগড়া, ন্যাড়চা, ছোটপেলিয়ায় টুকুটুক করে হেঁটে ঘুরতেন। বলিয়ে-কইয়ে নন তেমন, তবু সবাই ভালবাসত। মিটিং শুনতে মেদিনীপুর, কলকাতার গড়ের মাঠে যেতেন। বিধুর কাছে সে-সব ভিন্ গ্রহ। লালগড়ের বাইরে কতটুকুই বা দেখেছেন পাড়াগেঁয়ে বউটি।
জঙ্গলে কাঠ কাটা, দেড় কিলোমিটার উজিয়ে জল আনা, এক বিঘে জমিতে চাষের কাজ, মাটি কাটা, ঘরের কাজ, ছেলেমেয়ের দেখভাল— সব তাঁর একার দায়িত্ব। বরাবরই। তবু একটা নিশ্চিন্দি ছিল। মাথার উপরে একটা ছাতা ছিল যেন। সেই ভোটের আগেই যা সরে গেল।
এক দশক আগের ভোটের কিস্সা জ্যান্ত হয়ে ওঠে স্বামীহারার চোখে। জঙ্গলমহলের হাসির কথাও মনে ভাসে। মোরামের রাস্তায় পিচের প্রলেপ। কিন্তু জলের কষ্ট তুঙ্গে। খুনোখুনি আপাতত বন্ধ। তবে মসৃণ পিচ পেরিয়ে ক্ষেতের ফসল তছনছ করতে হাতির পালের জঙ্গিপনা। জঙ্গলে এক দিন কাঠ কেটে মেলে ৭০ টাকা। সরকারি দু’টাকার চাল, ১০০ দিনের কাজের বার্ষিক ২৫০০ টাকায় সব কষ্ট ঘোচাতে পারে না।
তবু সত্যিই পরিবর্তনের ছড়াছড়ি। একদা সন্ত্রাসে অভিযুক্ত, জনসাধারণের কমিটির নেতা সঞ্জয় প্রতিহারী কাঁটাপাহাড়িতে বসে ভালবেসে তৃণমূল করার কাহিনি শোনান। কার্তিকের দলীয় সঙ্গী ভীম সরেন, মৃণাল সরেন, বঙ্কিম সিংহরা এখন সিপিএমের নাম নেন না।
পার্টির প্রতি অভিমানেও বুক ঠেলে ওঠে বিধুর! শুধু তো তৃণমূল সরকার নয়! পার্টিই বা কী করেছে? জেলার প্রবীণ সিপিএম নেতা মেনে নেন, অনেক ক্ষেত্রেই পার্টি টাকার জোগাড় করলেও নেতাদের ঘনিষ্ঠদের তেলা মাথায় তেল পড়েছে। সত্যিকারের অসহায়দের পাশে সব সময়ে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। বাঁধগড়ার কার্তিক ছাড়াও লালগেড়িয়া, সিজুয়া, জামবনির বঞ্চিতদের নাম ঘুরপাক খায় জঙ্গলমহলে। ভোটের বাজারে সব দলই যাদের চোখের জলে পসরা সাজিয়ে গেল।
ছেলেমেয়ে দু’টোর দিকে তাকিয়ে তবু আলোর ঝিলিক খেলে মায়ের চোখে। শত অভাবেও কারও পড়াশোনা বন্ধ হতে দেননি। কাঁটাপাহাড়ির বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দেবে উমা। বিয়ে করবে না। পুলিশ হতে চায়। বাবার ক্ষতিপূরণের কথা কেউ তুললেই সপাটে বলে, ‘‘ও-সব ভাবি না, মা যে-ভাবে আমাদের মানুষ করেছে তাতে গর্বিত।’’
ছেলে শুভেন্দু ক্লাস টেন। পাঠ্যবইয়ে ওক গাছ নিয়ে টেড হিউজের কবিতার সারসংক্ষেপ বলে নিরক্ষর মাকে। ‘‘গাছ কাটা ভাল নয় মা! আমি বড় হলে আর জঙ্গলে যেতে দেব না তোমায়!’’
আর ক’দিন। ন্যাড়চার স্কুলবাড়ির বুথ থেকে স্লিপ হাতে ঘরের দরজায় শাসক দলের ছেলেরা। ঝান্ডার রং পাল্টায়, দিনগুলো পাল্টাবে কবে? ম্লান হাসেন, নেই-রাজ্যের বাসিন্দা দুই সন্তানের নাছোড় জননী।