চওড়া রাস্তার পাশে স্টেশন ছোঁয়া গ্রামীণ মাঠ। লাইনের কোল ঘেঁষে পরপর তিনটে অর্জুন গাছ। লাইনের ও পারে অনন্ত সর্ষে ফোটা খেত, হলুদ হয়ে আছে।।
কালেভদ্রে সভা। পৌষ-মাঘে কচ্চিৎ যাত্রাপালা আর ভরা গরমে একের পর এক রঙিন বুটের ফুটবল—রেজিনগর স্টেশন মাঠ।
আটপৌরে সেই মাঠের অতীতটাই বেবাক ঘেঁটে গিয়েছিল সেই বিকেলে।
নির্বিষ সবুজ একটা মঞ্চকে সামনে রেখে ভরা মাঠ এক সময় প্রলম্বিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল লাইনের উপরে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিলেন স্টেশন মাস্টার। মঞ্চে উঠে হাত জোড় করে আকুতি করছিলেন— ‘‘স্যার লোকজনকে বলুন না একটু সরে দাঁড়াক। ট্রেনটা চলে যাক অন্তত!’’
‘মাস্টারের’ অমন অসহায় মুখ দেখে লোকটি হাসছে। সাদা বুশ শার্ট, ঢোলা পাৎলুন, বলছেন— ‘‘সোজা কথা বলি, দিদির তাই গোসা। এখন দেখ কেমন লাগে!’’
মাঠ, পাঁচিল, স্টেশন রোড, প্ল্যাটফর্মের চালে ওরা কারা? থিক থিক করছে লোক। মঞ্চের এক কোণে স্টেশন মাস্টারকে টেনে নিয়ে গিয়ে সেই বিকেলে বলছেন, ‘‘দোষ নেবেন না সাহেব, লোক সরিয়ে দেব। তবে ভিড়ের খবরটা একটু রাষ্ট্র করে দেবেন স্যার, আপনার হাতে তো রেলের লাইন রয়েছে!’’
সে দিন বিকেলে লোক সরে গিয়েছিল। ট্রেন চলেছিল তার নিজের পথে। এক সময় ভেঙে ছিল সমাবেশও। তবে, ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছিল সকলের। মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের এক নেতা বলছেন, ‘‘সেই কু়্ঞ্চিত ভ্রূটা কিন্তু সোজা হচ্ছে না।’’ ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, কংগ্রেসের খাসতালুকে ততোই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে— হলুদ ব্যাকড্রপে নিতান্তই আটপৌরে টেবিল প্রতীকটা। যার আড়ালে রয়েছেন তিনি।
আর, তিনি আছেন বলেই ওঁরা পরস্পরের হাত ছাড়ছেন না। মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের এক নেতা বলছেন- ‘‘‘আর যাই হোক, রেজিনগরে ওঁকে তো একটু সমীহ করতেই হবে। ভূতের মতো না হলেও, ভয়ের কারণ তো এক মাত্র তিনিই।’’ তিনি হুমায়ুন কবীর।
একদা অধীর চৌধুরীর দক্ষিণহস্ত। ‘‘দাদা’ হাঁ করলেই বুঝে নিতেন ঠিক কী চাইছেন। তৃণমূলের জোয়ারেও ঠিক ছিনিয়ে নিয়েছিলেন রেজিনগর। তবে দাদা-ভাইয়ের মন কষাকষি হয়েছিল পালাবদলের বছর ঘোরার আগেই। তার জেরেই দল ছেড়ে ডাকাবুকো হুমায়ুন ভিড়েছিলেন দিদির দলে। আর মন্ত্রীত্বের পালক গুঁজে সটান হাজির হয়েছিলেন মহাকরণে।
তবে, কপাল মন্দ। পুরনো দাদাকে বিস্তর গালমন্দ করেও উপ নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। তবে অধীর-বিরোধীতাকে মান্যতার পুরস্কার পেয়েছিলেন বটে দিদির কাছে। বিধায়ক পদ হারালেও মাস কয়েক তাঁকে মন্ত্রী রেখে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মুচকি হেসে হুমায়ুনও জানিয়েছিলেন, ‘‘‘সবই দিদির ইচ্ছা।’’
দল বিরোধী কথা বলায় সেই দিদির কোপেই দল থেকে এক সময়ে ছাঁটাইও হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
চেষ্টা করেছিলেন বিজেপিতে ভিড়তে। শেষ অবধি তা-ও হয়নি। তৃণমূলে নিঃশর্ত ফেরার জন্য বিস্তর চেষ্টা করেও টিকিটের শিকে না ছেড়ায় তাই নিজেই টেবিল প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন হুমায়ুন। বলছেন, ‘‘দেখুন না, খেলা এখনও বাকি।’’
পরিসংখ্যান অবশ্য সে কথা বলছে না। গত দু’টো বিধানসভা নির্বাচনে, রেজিনগর কেন্দ্রে বাম প্রার্থীরা ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। তবে, তার আগে অবশ্য ২০১১ সালে এই কেন্দ্রে হুমায়ুন জিতে ছিলেন ৮,৭৬১ ভোটে। দেড় বছরের মধ্যে, ২০১৩ সালে, এই কেন্দ্রেই উপনিবাচর্নে কংগ্রেসের রবিউল আলম চৌধুরীর কাছে প্রায় বারো হাজার ভোটে হেরে হারেন তিনি। ঠাঁই হয়েছিল সেই তৃতীয় স্থানে। তবে, এ বার কোন ভরসায় হুমায়ুন এমন হুঙ্কার ছাড়ছেন?
শাসক দলের এক নেতা সতর্ক করছেন, ‘‘মনে রাখতে হবে, রেজিনগর, শক্তিপুর এলাকায় হুমায়ুনের অনুগামীদের সংখ্যাটা অল্প নয়। কংগ্রেসের একটা অংশ এখনও তাঁর দিকেই ঝুঁকে রয়েছে।’’ অল্প সময়ে হলেও হুমায়ুনের নির্বাচনী প্রস্তুতিও তাঁর দেখার মতো। শক্তিপুরের গড়দুয়ারা মাঠে দু’টো সভাতেই তার প্রমাণ রেখেছেন তিনি। নির্দল প্রার্থীর সভায় এমন উপচে পড়া ভিড় দেখে কপালে ভাঁজ পড়েছে জোটের। হুমায়ুনের মিছিলেও লোক হচ্ছে যথেষ্ট।
ওই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী সিদ্দিকা বেগম। আদতে ডোমকলের বাসিন্দা সিদ্দিকাও কংগ্রেসের পুরনো নেতা। জেলা পরিষদের সভাধিপতি হয়ে জেলা সামাল দেওয়ার কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। তবে তিনি যে রেজিনগরে তেমন জোরালো লড়াই দিতে পারবেন, এমন আশা শাসক দলের জেলা নেতাদেরও নেই।
আর জোট প্রার্থী রবিউল? সিপিএমের রেজিনগর জোনাল কমিটির সম্পাদক মহম্মদ বদরউদ্দিনও স্বীকার করছেন ‘‘লড়াই একটা হবে ঠিকই, তবে সেটা কার সঙ্গে হিসেব কষছি সেটাই।’’ সভা শেষ। স্টেশন মাঠে দাঁড়িয়ে ঢোলা বুশ শার্ট বলছেন, ‘‘আমি বড় একা জানেন, তবে ১৯ তারিখের পরে সেই নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে পারব মনে হয, কী পারব না?’’