জোরালো এক ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে গেল। অন্ধকারে কে যেন ফিসফিস করে ভয়ার্ত গলায় কানের কাছে বলছে— ‘ও মশাই শুনতে পাচ্ছেন। বাইরে...।’
কথা শেষ হতে না হতেই একটা কর্কশ কন্ঠ কাকে ধমকে উঠল ‘সাচ বাতা, নেহি তো...।’ তারপরেই চোস্ত হিন্দিতে অকথ্য গালিগালাজ। ধাতস্থ হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। তারপরেই মনে পড়ল আমি ভোটের ডিউটিতে এসেছি। আপাতত চর-দিকনগরের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের মেঝেতে শুয়ে। কৃষ্ণনগর দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের বুথ নম্বর ২০৩। রাত পোহালেই ভোট।
আচমকা এমন হইচইয়ে মুহূর্তের জন্য সব কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ঘুম-টুম সব উধাও। গলা শুকিয়ে কাঠ। আওয়াজ বেরোচ্ছে না। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে অন্ধকারে হাতড়ে মোবাইল বের করে দেখি রাত পৌনে তিনটে। শেষতক যা থাকে কপালে বলে ঘরের দরজা খুললাম। ওই নিশুতি রাতে চাঁদের আলোয় সেনপুর-ডাঙাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্র খাঁ খাঁ করছে। সামনে যত দূর চোখ যায় শুধু ধানের খেত। একপাশে গভীর নলকূপ। কিন্তু কেউ কোথাও নেই।
এমনিতে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি বেশ ছিমছাম। পাকা ঘর। লাগোয়া বারান্দা। সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। পরিছন্ন শৌচাগার। জায়গাটি চক-দিকনগরের শেষ প্রান্তে। নাম ঢাকাপাড়া। সামনে রাস্তা। রাস্তার ওপারে যতদূর নজর যায় মাঠের পর মাঠ ধানখেত। এদিক ওদিক দেখে পাঁচ জনে সাবধানে পা রাখলাম বারান্দায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের ফাঁকা জায়গায় তাকাতেই পিলে চমকে গেল। এ কী কাণ্ড!
শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের বারান্দা থেকে ফুট পনেরো দূরে পাশাপাশি একটা খেজুর আর একটা আতাগাছ। সেই দুটো গাছ জড়িয়ে মাটি থেকে খানিকটা উঁচুতে ঝুলছে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা দু’জন লোক। আর তাদের দিকে জ্বলন্ত চোখে কালাশনিকভ তাক করে হাঁটু মুড়ে পজিশন নিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দুই জওয়ান। অন্য দুই জওয়ান ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে গাছ দু’টো। ব্যাপারটা কী?
সমস্বরে প্রশ্ন শুনে জওয়ানেরা যা জানালেন তার সারমর্ম হল, রাত আড়াইটে নাগাদ ওই দু’জন হাতে দা, বেলচা নিয়ে আমাদের ঘরের জানলায় উঁকি মারছিল। ওদের নাকি কু-মতলব ছিল। জওয়ানেরা দু’জনকেই ধরে ফেলেছে। আপাতত গাছে ঝুলিয়ে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। সকাল হলে অন্য ব্যবস্থা।
আমাদের অভয় দিয়ে জওয়ানেরা জানালেন, চিন্তার কোন কারণ নেই। আমরা যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাই। অগত্যা ঘরে এলাম। কিন্তু গাছে জলজ্যান্ত দু’টো মানুষকে ঝুলতে দেখে কারও ঘুম আসে নাকি? বিছানায় শুয়ে শুয়েই মনে হচ্ছিল— ওরা কারা? কেনই বা মাঝরাতে ভোট কেন্দ্রে দা নিয়ে ঘুরছিল? সকালে আবার কী হয় কে জানে! ভাবতে ভাবতেই পাঁচটা বাজল।
সকাল ছ’টা নাগাদ ফের হইচই। বিভিন্ন দলের এজেন্টরা এসে পড়েছেন। তাঁরাও ঝুলন্ত দু’জনকে দেখে তাজ্জব। পরে অবশ্য রহস্যের সমাধান করলেন তাঁরাই। জানা গেল, ওই দু’জন গ্রামেরই বাসিন্দা। এমনকী ওই বুথেরই ভোটার। গভীর নলকূপ চালানোর ঠিকা শ্রমিক। ভোরে জমিতে জল দেওয়ার জন্য রাত থাকতেই ওদের আসতে হয়। সে দিনও এসেছিল। দোষের মধ্যে নিছক কৌতূহলে উঁকি মেরে দেখতে গিয়েছিল ভোট করতে আসা লোকগুলোকে। ব্যস! কিন্তু বাংলায় অনভ্যস্ত জওয়ানেরা সে কথা বুঝলে তো! মক-পোল মাথায় উঠল। খবর গেল সেক্টরে। কর্তারা ছুটে এলেন। গ্রামের মানুষ ওই দু’জনের হয়ে মুচলেকা দিলে তবেই লোক দু’টো রেহাই পেল। গাছ থেকে নামানো হল তাদের।
সাড়ে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় গাছে ঝুলে থাকার পরে সেই যে তারা ওখান থেকে গেল, আর তাদের বুথে দেখা মেলেনি। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। কিন্তু আধাসেনা ছুঁলে...