ভারতী ঘোষ
‘সরকারের’ প্রিয়পাত্রী তিনি। আর তাঁর হয়ে দরবার করতে গিয়েই নাক কাটা গেল সরকারি প্রশাসনের। তিনি, মানে আইপিএস ভারতী ঘোষ। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় যিনি ‘ভাল মেয়ে।’ ভারতীকে ভোটের মুখে জঙ্গলমহল থেকে সরিয়ে সোজা কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোঁসা হয়েছিল। তাঁর নির্দেশে দিল্লির নির্বাচন সদনে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব। কিন্তু জবাবে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদীর কাছে কার্যত ধমক খেয়ে পিছু হটেছেন নবান্নের কর্তারা।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ‘বিশেষ’ সম্পর্কের সুবাদে জঙ্গলমহলে টানা তিন বছর এসপি-র দায়িত্ব সামলেছেন ভারতীদেবী। ফলে কমিশনের নিয়ম মেনে বিধানসভা ভোটের আগে তাঁকে সরতেই হতো। কিন্তু ভোটের জঙ্গলমহলে ওঁকে যে মুখ্যমন্ত্রীর ‘খুবই প্রয়োজন!’ তাই রাতারাতি তৈরি হয় নতুন পদ— ওএসডি অপারেশন্স (লেফ্ট উইং এক্সট্রিমিজম)। যে চেয়ারে বসিয়ে ভারতীকে রেখে দেওয়া হয়েছিল জঙ্গলমহলেই।
তবু শেষরক্ষা হয়নি। ভোটের বাদ্যি বাজতেই ভারতীর কাজকর্ম নিয়ে কমিশনে ভুরি ভুরি অভিযোগ জমা হতে থাকে। কমিশন রাজ্য সরকারের ব্যাখ্যা তলব করে। রাজ্য জানায়, বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরে সদর দফতর বানিয়ে জঙ্গলমহলে ‘মাওবাদী দমনের’ কাজ করছেন ভারতী। ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না-হয়ে গত ১৯ মার্চ কমিশন নির্দেশ দেয়, ভারতীকে সিআইডি’তে পাঠানো হোক। কলকাতায় ভবানী ভবনে বসে তিনি কাজ করবেন।
তত দিনে ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে গিয়েছে। অগত্যা সরকার নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়। এর ঠিক আগে কমিশনের আজ্ঞায় আরও কিছু পুলিশ অফিসার বদলি হয়েছিলেন। তবে ভারতীর অপসারণকে তাঁরা যে মোটেই ভাল ভাবে নিচ্ছেন না, তা জানিয়ে মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি লিখেছিলেন নির্বাচন সদনে। তাতে বলা হয়, জঙ্গলমহলের আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থেই ওই অফিসারকে ভেবে-চিন্তে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল। ‘ওঁকে সরানোয় ওখানে গোলমাল বাঁধলে দায় কার উপরে বর্তাবে? কমিশন কি দায়িত্ব নেবে?’— চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছিল নবান্ন।
কমিশন সূত্রে খবর: রাজ্য পুলিশের কিছু আধিকারিকের ‘পক্ষপাতমূলক’ কাজকর্ম ও সে সম্পর্কে ‘প্রশাসনিক নির্লিপ্তি’র অভিযোগ ঘিরে নির্বাচন সদনের অন্দরে কিছুটা অসন্তোষ ছিলই। এই চিঠিতে যেন আগুনে ঘি পড়ে। কমিশনের ফুল বেঞ্চ এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে যে, মুখ্যসচিবকে জবাবি চিঠি পাঠিয়ে তারা কার্যত ধমক দিয়েছে।
কী রকম? মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখে কমিশন পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে, ‘রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি এমনই, যে এক জন অফিসারকে সরিয়ে দিলে বিস্তীর্ণ এলাকায় গোলমাল বাধতে পারে?’ নবান্নকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সংবিধান মোতাবেক আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব রাজ্যের। কমিশনকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। ‘জঙ্গলমহল বা রাজ্যের অন্য কোথাও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হলে পুরো দায় রাজ্যকেই নিতে হবে।’— সাফ জানিয়েছে কমিশন। চিঠিতে এ-ও হুঁশিয়ারি— ‘কমিশনের কর্তব্য অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন। সে জন্য
রাজ্যকেই যাবতীয় সহায়তা করতে হবে। এতে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য বরদাস্ত করা হবে না।’
এ হেন কড়া জবাব পেয়ে নবান্ন বিলকুল গুটিয়ে গিয়েছে। এক শীর্ষ কর্তার পর্যবেক্ষণ— ভারতী ঘোষের বদলির প্রতিবাদ করতে গিয়ে মুখ পুড়েছে। তাই আর টুঁ শব্দটি করা হচ্ছে না। উল্টে মুখ্যসচিব গত সোমবারের ভিডিও কনফারেন্সে কমিশনের নির্দেশের অংশবিশেষ পড়ে শুনিয়েছেন ডিএম-এসপি’দের।
কিন্তু কমিশনের ফরমান পেয়েও বিবাদে জড়ানোর যুক্তি কী? নবান্নের একাংশের বক্তব্য: কমিশন অন্য যে ৩৭ জন অফিসারকে সরিয়েছে, তাঁরা ভোটের কাজে যুক্ত ছিলেন। ভারতী ছিলেন না। তাই সরকার প্রশ্ন তুলেছে। আমলাদের অন্য অংশ বলছে ‘‘সরকারের মুখিয়া চাইলে আমলারা কী করবেন? মাথার মর্জি মানতে গিয়েই মান খোয়াতে হল!’’— খেদ তাঁদের। নারদ-প্রসঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, ‘মাথা’ চায়নি বলেই এক আইপিএসকে ঘুষ
নিতে দেখেও চুপ করে থাকতে হয়েছে।
ভারতী-অপসারণের পিছনে দিল্লির যুক্তি কী? কমিশনের এক কর্তার দাবি: তাঁরা নিজস্ব সূত্রে খবর পেয়েছিলেন, সরাসরি ভোটের কাজে যুক্ত না-থেকেও ভারতী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নাক গলাচ্ছেন। জঙ্গলমহলের নিচুতলার পুলিশ ও শাসকদলের একাংশের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রেখে চলছেন। তাই তাঁকে সরানো হল। উল্লেখ্য, গত লোকসভা ভোটের আগেও কমিশন ভারতীর দায়িত্ব কেড়েছিল। যদিও তার পরে তিনি এসপি বাংলোতে ঘাঁটি গেড়েই দিব্যি ভোটের কাজে নাক গলিয়ে যান বলে অভিযোগ ওঠে। এ বার তাই কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে ওঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছে।
গত তিন বছরে জঙ্গলমহলে ভারতীর ভূমিকায় নানা বিতর্ক দানা বেঁধেছে। গত বছর পিংলার ব্রাহ্মণবাড়ে বিস্ফোরণে ১৩ জনের মৃত্যুর পরে মুখ্যমন্ত্রী রায় দেন, ওখানে বিয়েবাড়ির বাজি তৈরি হচ্ছিল। পশ্চিম মেদিনীপুরের তদানীন্তন এসপি ভারতীও মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মেলাতে দেরি করেননি। পরে গোয়েন্দা-রিপোর্টে জানা যায়, বেআইনি কারখানাটিতে দেশি বোমাও তৈরি হতো। আবার সবং কলেজে ছাত্র পরিষদ কর্মী খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত টিএমসিপি’র ছেলেদের আড়াল করার জন্য ভারতীর দিকে আঙুল উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রীর সুরে তিনি জানিয়েছিলেন, খুনের মূলে ছাত্র পরিষদের অন্তর্দ্বন্দ্ব।। চার্জশিটেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে লঘু ধারা দেওয়া হয়। পাশাপাশি খড়্গপুর পুরভোটে শাসকদলের পক্ষ নিয়ে বিরোধীদের ভাঙিয়ে বোর্ড দখলে ভারতীর হাত ছিল বলে অভিযোগ।
এ বার এল কমিশনের ধমক। বদলি-নির্দেশের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ভারতী বলেছিলেন, ‘‘লিখে নিন, ভারতী ঘোষ এখন নন্দ ঘোষ।’’ দেখা যাচ্ছে, সেই নন্দ ঘোষের জন্যই মুখ পুড়ল নবান্নের।