ঝাড়খণ্ড সীমানাবর্তী এলাকায় উঁকি ঝুঁকি মারছে মাওবাদীরা। তৃণমূলি-বঞ্চনার সাতকাহন নিয়ে এলাকায় গোপন-প্রচার চলছে বলেও খবর। পাল্টা প্রচারে গিয়ে তৃণমূলের মাত্র সাড়ে চার বছরের জমানায় কত বিপুল উন্নয়ন হয়েছে, সেই কথাটাই ফলাও করে বলছেন বংশীবদন মাহাতো। তৃণমূলের বেলপাহাড়ি ব্লক সভাপতি বংশীবদনবাবু বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিও। তিনি প্রার্থী নন। তবে এলাকায় গুঞ্জন, বকলমে তিনিই প্রার্থী!
নিন্দুকেরা বলছেন, বংশীবদনবাবু রাজনীতিতে ও হিসাবশাস্ত্রে বেশ দ়ড়। সেই জন্যই দলের শীর্ষস্তরে তদ্বির করে নিজের অনুগত খগেন্দ্রনাথ হেমব্রমকে প্রার্থী করেছেন, যাতে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে উন্নয়নের ভাগাভাগির রাশটা নিজের হাতেই ধরে রাখা যায়। আর এই নিয়েই তৃণমূলের অন্দরে নানা অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। তাই খগেনবাবুকে চোখের আড়াল করছেন না বংশীবদনবাবু। ়
তৃণমূলের অন্দরের খবর, ব্লক সভাপতির কাছের লোক হিসেবে পরিচিত খগেন্দ্রনাথ হেমব্রমকে প্রার্থী করায় বেলপাহাড়ি ও জামবনি ব্লকের ২০ টি অঞ্চলের সিংহভাগ নেতা-কর্মী ক্ষোভে ফুঁসছেন। তাই প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে বংশীবদনবাবুই প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গে থাকছে গোটা আটেক নিরাপত্তা-রক্ষী। সত্তরোর্ধ্ব খগেন্দ্রনাথবাবু প্রচারের ধকল নিতে পারছেন না। যে কারণে দলের বেশির ভাগ নির্বাচনী প্রচার কর্মসূচিতে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক খগেনবাবু একসময় বেলপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের ঝাড়খণ্ডী প্রধান ছিলেন। ২০০৪ সালে ঝাড়গ্রাম লোকসভা আসনে খগেনবাবু ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর প্রার্থীও হন। রাজ্যে ক্ষমতার পালা বদলের পরে বংশীবদনবাবুর উদ্যোগে তৃণমূলে যোগ দেন এই প্রবীণ মানুষটি।
কিন্তু সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ-প্রার্থীকে নিয়ে আপত্তি তুলেছেন তৃণমূলের নতুন প্রজন্মের নেতা-কর্মীর অনেকেই। ওই মহলের দাবি, আদিবাসী সংরক্ষিত বিনপুর আসনটি দখল করতে গেলে তরুণ মুখের প্রয়োজন ছিল। প্রবীণ খগেনবাবুকে প্রার্থী করায় হতাশ শাসকদলের যুযুধান বিভিন্ন গোষ্ঠী। আদিবাসী বলয়ে দলীয়স্তরে অসন্তোষ আরও দানা বাঁধার অন্য কারণও রয়েছে। মাস দু’য়েক আগে মাওবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে তৃণমূলের ভেলাইডিহা অঞ্চল সভাপতি জয়রাম টুডু গ্রেফতার হন। দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে জয়রামকে ফাঁসানো হয়েছে বলে প্রকাশ্যেই সোচ্চার হন তৃণমূল কর্মীদের একাংশ। বিষয়টি নিয়ে আদিবাসী সমাজের লোকজনও ক্ষুব্ধ।
এ বার বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএম প্রার্থী হয়েছেন বিদায়ী বিধায়ক দিবাকর হাঁসদা। রয়েছেন ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) প্রার্থী সাঁওতালি সিনেমার নায়িকা বিরবাহা হাঁসদা। এছাড়া আছেন বিজেপি, এসইউসি এবং আজসু পার্টির প্রার্থীরা। রাজনৈতিক মহলের গুঞ্জন, এ বার যেহেতু ঝাড়গ্রাম আসনে বামেদের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন চুনিবালা হাঁসদা। তাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দিবাকরবাবুকে জেতানোর জন্য মেয়ে বিরবাহাকে বিনপুরে প্রার্থী করেছেন চুনিবালা। বিরবাহা নতুন প্রজন্মের আদিবাসী ভোট কেটে আখেরে দিবাকরবাবুর সুবিধে করবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। আদিবাসী সমাজের একাংশ বিরবাহাকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় চিন্তা বেড়েছে শাসক শিবিরের।
২০১১-র বিধানসভা ভোটে রাজ্যে পরিবর্তন ঝড়েও ব্যতিক্রম ছিল বিনপুর। কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের নির্দল প্রার্থী চুনিবালা হাঁসদাকে মাত্র ৭ হাজার ৬১০ টি ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী হন সিপিএমের দিবাকর হাঁসদা। গত বিধানসভা ভোটে দিবাকরবাবু পান ৬০,৭২৮টি ভোট (৪১.১৭%)। তৃণমূল জোটের প্রার্থী চুনিবালা পেয়েছিলেন ৫৩,১১৮টি ভোট (৩৬%)। গোঁজ প্রার্থী অর্জুন হাঁসদা ১৪,৪৫৯টি ভোট (৯.৮০%) কেটে নেওয়ায় হেরে যান চুনিবালা। গত বিধানসভা ভোটে এই আসনে বিজেপি প্রার্থী মাত্র ৫.২৮% ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিনপুর আসনে অনেকটাই এগিয়ে ছিল তৃণমূল। লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের বিনপুর বিধানসভা ভিত্তিক ফলের পরিসংখ্যান বলছে, তৃণমূল প্রার্থী উমা সরেন পেয়েছিলেন ৮৪,১৮৫টি ভোট। সিপিএমের পুলিনবিহারী বাস্কের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৭,৩২৮টি। বিজেপি প্রার্থী বিকাশ মুদি পেয়েছিলেন ১৬,৩২৮টি ভোট। ৬ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী অনিতা হাঁসদা। আর ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) প্রার্থী চুনিবালা হাঁসদা পেয়েছিলেন মাত্র হাজার তিনেক ভোট।
এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে বাসিন্দাদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ বাড়ছে। এখনও ওদলচুয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ চালু হয়নি। অন্য দিকে, বেলপাহাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালেও যথাযথ পরিষেবা মেলে না বলে অভিযোগ। গরম পড়তেই পানীয় জলের তীব্র সঙ্কট শুরু হয়েছে এলাকায়। ভোটের মুখে বেলপাহাড়িতে তড়িঘড়ি জলপ্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছে বটে, কিন্তু জল সরবরাহ শুরু হয়নি। তৃণমূলের ক্ষমতাসীন গ্রাম পঞ্চায়েত গুলির বিরুদ্ধে উন্নয়নের টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। এসবই প্রচারে আনছেন সিপিএম প্রার্থী দিবাকরবাবু। তিনি বলেন, “জনগণ তৃণমূলের সঙ্গে নেই। ওরা যেখানেই যাচ্ছেন রোষের মুখে পড়ছেন। এলাকাবাসী আমাদের পাশে আছেন।”
বিরবাহার বক্তব্য, “তৃণমূলের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে রায় দেবেন ভোটাররা।” তৃণমূল প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ হেমব্রমের কথায়, “উন্নয়ন-শান্তির নিরিখে মানুষ পরিবর্তন করবেন।” বেলপাহাড়ি ব্লক তৃণমূলের সভাপতি বংশীবদন মাহাতোর দাবি, “আমি দলের ব্লক সভাপতি। আমার অঙ্গুলি হেলনে দলের কাজ পরিচালিত হবে, এটাই দস্তুর। খগেনবাবুকে ৭০ হাজার ভোটে জেতাব।”
খগেনবাবুর সমর্থনে শিলদায় জনসভা করে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচনী সভা করেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুকুল রায়। তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা এসেছিলেন হেলিকপ্টারে। ভালই জমায়েত হয়েছিল। ওই সভার পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র’র পড়িহাটির নির্বাচনী সভায় জমায়েতের বহর দেখে চিন্তায় শাসক-শিবির ।
আসমান-জমিন ফারাকের অস্বস্তি কাটছে না কিছুতেই!