বাতাসে বেইমানি, হাতে রইল কাস্তে

বেইমানি! পৌনে তিনশো বছরেও ইতিহাস পাল্টাল না? বেইমানি! নবাবি মসনদের সঙ্গেই কি শব্দটা জড়িয়ে গিয়েছে চিরকালের মতো? আকাশ জ্বলছে। চোখ কুঁচকে ধোঁয়ানো দিগন্তের দিকে চেয়ে মনে-মনে উত্তর খুঁজছেন তিনি। বিভাস চক্রবর্তী। ফরওয়ার্ড ব্লক। বামফ্রন্ট। একটু ভুল হল, বামফ্রন্ট মাইনাস সিপিএম। ধর্মযুদ্ধে একা!

Advertisement

শুভাশিস সৈয়দ

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৩৫
Share:

বেইমানি!

Advertisement

পৌনে তিনশো বছরেও ইতিহাস পাল্টাল না?

বেইমানি!

Advertisement

নবাবি মসনদের সঙ্গেই কি শব্দটা জড়িয়ে গিয়েছে চিরকালের মতো?

আকাশ জ্বলছে। চোখ কুঁচকে ধোঁয়ানো দিগন্তের দিকে চেয়ে মনে-মনে উত্তর খুঁজছেন তিনি।

বিভাস চক্রবর্তী।

ফরওয়ার্ড ব্লক। বামফ্রন্ট।

একটু ভুল হল, বামফ্রন্ট মাইনাস সিপিএম। ধর্মযুদ্ধে একা!

কার ধর্ম? কোন ধর্ম?

সিপিএম মজেছে জোটধর্মে। তাই কংগ্রেস প্রার্থী, এই কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক শাওনী সিংহ রায় মনোনয়ন জমার দিন থেকে পাশে পেয়েছেন কাস্তে-হাতুড়িকে। এখনও পাচ্ছেন, রোজ, মিটিংয়ে-মিছিলে।

আর বিভাস ক্রমশ দার্শনিক হয়ে উঠছেন। তিনি জানেন, শুধু সিপিএম নয়, তাঁর দলেও ছুরিতে শান দেওয়া হচ্ছে গোপনে। যে কোনও মুহূর্তে তা পাঁজরে বসে যেতে পারে আমূল!

কিন্তু কে আর ঘরের কেচ্ছা মানতে চায়? বিভাস তাই বলছেন, ‘‘দলের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল ঠিকই। কিন্তু তা দূর করা গিয়েছে। এখন আর কোনও মান-অভিমান নেই। সকলেই এককাট্টা হয়ে ভোটে লড়ছেন।’’

বড় শরিক সিপিএমও?

‘নাঃ’ — মাথা নাড়ছেন বিভাস— ‘‘ওরা নেই পাশে। ধর্মচ্যুত।’’

ওরা তো জোটধর্মে আছে। সেটাই তো এ বারের বামধর্ম, তাই না?

শুনেই ফোঁস করে উঠছেন বিভাস, ‘‘কীসের জোট? রাজ্য বামফ্রন্ট থেকে প্রার্থী হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা বামফ্রন্ট এবং সিপিএমের জেলা কমিটিও আমার হয়ে প্রচার করার নির্দেশ দিয়েছে। তা সত্ত্বেও সিপিএমের লালবাগ জোনাল সম্পাদক বেইমানি করেছেন!’’

কেন? তাতে কী অষ্টবর্গ লাভ?

‘‘বুঝলেন না? এই সুযোগে এখানে ফরওয়ার্ড ব্লককে সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল করে দেওয়া গেলে পরে এই আসনটি ভোগদখল করে ভোটের পর ভোটে লড়বে সিপিএম। সহজ, এ তো শিশুও বোঝে!’’

আটটি পঞ্চায়েত মুকুন্দবাগ, ডাহাপাড়া, বাহাদুরপুর, কাপাসডাঙা, নতুনগ্রাম, প্রসাদপুর, তেঁতুলিয়া, ডাঙাপাড়া এবং দুটি পুরসভা—জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ এবং মুর্শিদাবাদ নিয়ে মুর্শিদাবাদ বিধানসভা কেন্দ্র। এর মধ্যে তিনটে পঞ্চায়েত বামফ্রন্টের দখলে। কংগ্রেসের দখলে একটি মাত্র পঞ্চায়েত ডাঙাপাড়া। দলবদলের জেরে বাকি চারটি পঞ্চায়েত দখল করে তৃণমূল। মুর্শিদাবাদ-জিয়াগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতি এবং আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জ পুরসভা বামফ্রন্টের হাতে। মুর্শিদাবাদ পুরসভা কংগ্রেসের।

এই অবস্থায় সিপিএমের লালবাগ জোনাল কমিটি (পড়ুন, সিপিএম) কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ানোয় এই কেন্দ্রে এক লাফে অনেকটাই শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে জোটের। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটপ্রার্থী শাওনী ৭৫ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। ৬৯ হাজার ভোট পেয়েছিলেন বামফ্রন্ট প্রার্থী বিভাস। বিজেপি দশ হাজার পেরোয়নি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট বাড়ে ১০ শতাংশ। বাম এবং কংগ্রে, উভয় পক্ষেরই ভাল রকম রক্তক্ষরণ হয়। প্রায় ৩০ শতাংশে এসে থমকে দাঁড়ায় দুই দলই। বিজেপি না-হয় মোদী হাওয়ায় বিড়াল থেকে ফুলে বাঘ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু আসল শক্তিবৃদ্ধি করে তৃণমূল। তৃতীয় কিন্তু বিপজ্জনক শক্তি হিসেবে এক ঝটকায় ২০ শতাংশে উঠে আসে তারা।

এ বারও মরিয়া কামড় দেওয়ার চেষ্টা করছে তৃণমূল। তাদের ব্যবসায়ী প্রার্থী অসীম ভট্ট ভোটের খরচ-খরচা চালাতে নিজেই অনেকটা গৌরী সেন। তার উপরে প্রচারে বেরিয়ে প্রতিটি অঞ্চলে এবং দু’টি পুরসভায় ‘বিধায়ক পরিষেবা কেন্দ্র’ গড়ে তুলবেন বলে তিনি ভোটারদের টোপ দিচ্ছেন।

সেটা আবার কী বস্তু? খায়, না মাথায় দেয়?

অসীমের দাবি, ‘‘গত পাঁচ বছরে এই কেন্দ্রের বিধায়ককে চোখে দেখেননি এলাকার মানুষ। বিধায়কের কাছ থেকে শংসাপত্র নিতেও সেই ডোমকল ছুটতে হত। আমি জিতলে প্রতিটি এলাকায় একটি করে বিধায়ক পরিষেবা কেন্দ্র গড়ে তুলব।’’

তাই না কি? আগের বিধায়ককে মোটে নাগালে পাওয়া যেত না?

আগের বিধায়ক শাওনী পাল্টা বলছেন, ‘‘উনি ব্যবসায়ী মানুষ তো! ব্যবসার কাজে বছরের বেশির ভাগ সময়ে কলকাতায় বা দিল্লিতে পড়ে থাকতে হয়। তিনি কি করে জানবেন আমি কত দিন মানুষের পাশে থাকি? আমার নামে মিথ্যা প্রচার ও ব্যক্তি কুৎসা করে কোনও লাভ হবে না।’’

অসীম বলছেন, জিতলে তিনি মানুষের পাশে থাকবেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কী করে জিতবেন?

অসীম বলছেন, তাঁর দুই ভরসা— বাবা আর মমতা। কী রকম?

‘‘আমার বাবার নামে একটি ট্রাস্ট আছে। ওই ট্রাস্টের মাধ্যমে সারা বছর ধরে আমি মানুষের বিভিন্ন উপকার করি। সেই সঙ্গে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন’’— তেড়ে ঢ্যাঁড়া পেটাচ্ছেন অসীম।

একাই পেটাচ্ছেন? সঙ্গে তো দলের লোকজন বিশেষ চোখে পড়ছে না?

অসীম ফুঁসে উঠছেন— ‘‘এই ধরনের অপপ্রচার করে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরির চেষ্টা চলছে। জেলা সভাপতি থেকে ব্লক সভাপতি সকলেই আমার সঙ্গে রয়েছেন। বুথ স্তরের কর্মীরা আমার হয়ে ভোট করতে মুখিয়ে আছেন।’’

এর অর্ধেকও যদি সত্যি হয়, তা হলেই বোঝা যাবে, বিভাস কেন একা দিগন্তের দিকে চেয়ে। আর, সিপিএম কেন ঘরের মানুষ ফেলে অধীর হয়ে পরের হাত ধরেছে।

আলিমুদ্দিন মুখে যা-ই বলুক, যে কোনও মূল্যে তৃণমূলকে আটকাতে বধ্যপরিকর তারা। জোটের স্বার্থে দরকারে কর্মীদের বসে যেতে বলবেন বলেও সূর্যকান্ত মিশ্রেরা আগেই জানিয়ে রেখেছেন। মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে তৃণমূল যে ‘গোকুলে বাড়ছে’ তা তারা অনেক আগেই বুঝেছে। কিন্তু বিভাস অ্যান্ড কোং-কে বোঝাতে পারেনি।

বিভাসেরা খালি এত দিন চলে আসা রেষারেষির ইতিহাসটাই উল্টে-পাল্টে দেখছেন। সেই কবে ১৯৮৭ আর ১৯৯৬-এর বিধানসভা ভোটে সিপিএম ‘গোঁজ’ দাঁড় করিয়ে তাদের ছায়া ঘোষকে হারিয়ে দিয়েছিল, তা তারা ভুলতে পারছে না। ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’ বলে যে একটা শব্দ এত দিন বাম মহলে চিউয়িং গামের মতো মুখে লেগেই থাকত, তা-ও বোধহয় তাঁরা ভুলেই গিয়েছেন।

তাতে কী?

নিজের নাক কেটে রক্তারক্তি করলেও সিপিএম-কংগ্রেস জোটের যাত্রাভঙ্গ করার ক্ষমতা কি ফরওয়ার্ড ব্লকের আছে? অন্তত লালবাগ ঘেরা এই নবাবি ময়দানে?

সিপিএম আপাতত ‘চুপচাপ হাতে ছাপ’ মোডে। মুখে কথাটি নেই, খালি হাতে-কাস্তেয় কাজ। ‘নাম না লিখলে বলি’ বলে এক এক নেতার কটাক্ষ, ‘‘ওদের (পড়ুন, ফরওয়ার্ড ব্লক ও বিভাস) সংগঠন এখন অতীত। আর, জোটপ্রার্থী জেতার যেখানে সম্ভাবনা আছে, সেখানে কর্মীদের জোটের হয়ে লড়তেই তো বহরমপুরের কর্মিসভায় এসে বলে গিয়েছেন সূর্যকান্ত মিশ্র। তার পরেও ওরা... বেইমান!’’

ব্রিটিশ দোরগোড়ায়।

কে সিরাজ আর কে মিরজাফর, সেটাই শুধু স্পষ্ট হল না!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement