এ বারের ভোট যেন উৎসব। সোমবার, সল্টলেকের বৈশাখীতে। ছবি: শৌভিক দে।
একই জায়গা, একই রকম সকাল। অথচ কত আলাদা!
সে দিনের শুরুতে বারান্দায় বেরিয়ে দেখেছিলাম, বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক দঙ্গল ছেলে। কাউকে চিনি না! কারা? কোত্থেকে এল? এই সময়ই বা কেন?
এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বুথে ঢোকার মুখে ওদের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম। তার পরের ঘটনা যেন দুঃস্বপ্ন। ভোট লুটেরা বহিরাগতেরা এক জনকে মারছে দেখে রুখতে গিয়েছিলাম। ওরা আমার উপরে চড়াও হয়। মাটিতে ফেলে পেটায়। আমার ছেলেকে মারে, স্ত্রীকেও গালিগালাজ করতে ছাড়েনি।
সেটা ছিল গত বছরের তেসরা অক্টোবর। সল্টলেক পুরভোটের দিন। দুষ্কৃতী দলের অবাধ দাপাদাপিতে যা কিনা প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। মিডিয়ার দৌলতে আমার মতো অনেকের হেনস্থার ছবি পৌঁছে গিয়েছিল ঘরে ঘরে। সল্টলেকের অন্ধকার অধ্যায়টির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের নামও।
সাত মাস বাদে আবার এক ভোটের সকাল। যন্ত্রণার স্মৃতিগুলো সারা রাত ঘুরে-ফিরে এসেছে। আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠেছে বারবার। সোমবার ভোরে তাই বিছানা ছেড়েই সোজা বারান্দায়। দেখি, সামনের রাস্তা বিলকুল ফাঁকা! ঝুঁকে এ-দিক ও-দিক চাইলাম। সেই মুখগুলো নেই! শুধু বন্দুক হাতে ইতি-উতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্যারামিলিটারির জওয়ানেরা।
গোটা দৃশ্যটাই যেন ভরসার বাতাস বয়ে আনে। আসলে প্রশাসন নিজের উপস্থিতি ঠিকঠাক জানান দিলে দুর্বৃত্তেরা মাথা তুলতে পারে না। এটাই নিয়ম। গত বার যার ব্যত্যয় ঘটেছিল। এ বার নিয়মের চাকা স্বস্থানে ফিরতেই সব স্বাভাবিক! অন্তত আমাদের এবি-এসি ব্লকে প্রাইমারি স্কুলের বুথে।
আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে পার্কের পাশের বুথটিতে এ দিন সকাল থেকেই বৈধ ভোটারদের সুশৃঙ্খল লাইন। সকলে নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে হাসি মুখে বেরিয়েছেন। বেলার দিকে আমিও গেলাম। চেনা-পরিচিতদের সঙ্গে আড্ডা জমল। রীতিমতো উৎসবের পরিবেশ। এটাই তো সল্টলেকের চেনা ছবি! আমাদের গর্ব!
পুরভোটে কয়েক হাজার মারমুখী বহিরাগত এসে এই উজ্জল ছবিতে একরাশ কালি ঢেলে দিয়েছিল। কেড়ে নিয়েছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে পেশিশক্তি চিরস্থায়ী হতে পারে না। মানুষ আবার একজোট হয়ে ভোটের বাক্সে নিজের মতামত দিয়েছেন। সল্টলেক দেখিয়ে দিয়েছে, পেশিশক্তির বিরুদ্ধে সাহস করে রুখে দাঁড়ানো যায়, আর তাতে ফলও মেলে।
বাড়ি এসে টিভি’তে দেখলাম তামাম সল্টলেকেই শান্তি-শৃঙ্খলায় নিরুপদ্রব ভোট হয়েছে। দেখে মন ভরে গিয়েছে। পুরভোটে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমার ও আমার পরিবারের প্রতিবাদ যে কোথাও কাজে এসেছে, সেটা ভেবেও তৃপ্তি হচ্ছে। সে দিন হয়তো অনেকে সাহস করে সামনে আসতে পারেননি। কিন্তু এ দিন বুথে-বুথে জনস্রোত বুঝিয়ে দিল, ওই প্রতিবাদের পিছনে সমর্থনের জোর কতটা। বস্তুত গত ক’দিনে নানা লোকের কথাবার্তায় এর একটা আঁচও যেন পাচ্ছিলাম। পুলিশ থাকুক না-থাকুক, সল্টলেকবাসী বুঝি ভেবেই রেখেছিলেন, ২০১৫-র ‘কলঙ্ক’ এ বার মুছে দেবেন!
সন্দেহ নেই, প্রশাসনের দৃপ্ত উপস্থিতি সাহসটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের স্থানীয় কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন। পুরভোটের দিন ওঁর সঙ্গে আমার কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। এ দিন উনি এগিয়ে এসে আমাকে বললেন, ‘‘আজ থেকে ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেল।’’ আমি বললাম, ‘‘ভুল বোঝাবুঝি ছিলই না।’’ আমার গলা জড়িয়ে অনিন্দ্যর ছবিও উঠল অনেক।
পুরভোটের পরে একটা কথা চাউর হয়েছিল— রাজ্য জুড়ে নাকি ‘সল্টলেক মডেলে’ই ভোট হবে। শুনে কষ্ট হতো। এখন অনেক হাল্কা লাগছে। জোর গলায় বলছি, এ দিনের ‘সল্টলেক মডেলে’ যদি সারা রাজ্যে ভোট হয়, তার চেয়ে ভাল কিছু হতে পারে না। আরও ভাল হবে, যখন পেশিশক্তিকে দাবিয়ে রাখার তাগিদে প্রশাসনকে প্রতি পদে নিজের উপস্থিতি জাহির করতে হবে না। কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়াই মানুষ নির্বিঘ্নে, উৎসবের মেজাজে ভোট দিতে পারবেন।
তখন পুরোপুরি সার্থক হবে আমাদের প্রতিবাদ।