হরকাবাহাদুর ছেত্রী। —ফাইল চিত্র।
মর্গান হাউস-এ নাকি সাহেব ভূতেরা ঘুরে বেড়ায়!
কালিম্পং শহর থেকে দু’কিলোমিটার দূরে গল্ফ কোর্স। উল্টো দিকে ব্রিটিশ আমলের ঢাউস বাংলো। সারা বছর পর্যটকদের ভিড় সেই মর্গান হাউসে। আশেপাশের অনেকেই একে ‘ভূত-বাংলো’ বলে ডাকেন। রাতে তো বটেই, বৈশাখের ভরদুপুরেও বাংলোয় গেলে গা ছমছম করে ওঠে। সেটাই হয়তো সরকারি এই বাংলোর ‘ইউনিক সেলিং পয়েন্ট’ (ইউএসপি)।
পাহাড়ের ভোটেও কি এমনই ভূত উড়ে বেড়ায় চারদিকে? শুনে কেউ মুচকি হাসেন। কেউ না শোনার ভান করেন। কেউ গলা নামিয়ে কথা বলেন। কিন্তু ভূতের গল্প উড়িয়ে দেন না কেউ-ই। বরং, ভোটের মরসুমে সিকিম-ভুটান থেকে উড়ে আসা হিমেল বাতাসে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে ভূত পোষার নানা গল্প-কথা। পাহাড়ের প্রবাদ, ভূতেরা নাকি ভয় পায় শুধু বিমল গুরুঙ্গকে। তাই সমতলে যাঁরা ভূত পোষেন, তাঁদের অনেকে আবার পাহাড়ে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। সমতলের নেতা-নেত্রীদের আলোচনায় শোনা যায় নানা খেদও। যেমন, পাহাড়ের জামুনি থেকে রিমবিক, এলাচ বনে ঘেরা কালিম্পঙের তোদে-তাংতা কিংবা সিনকোনাময় গৈরিবাসের আনাচে-কানাচে নাকি ‘জিলিপি’ ভূতেদের ট্রেনিং হয়।
কারা এই ‘জিলিপি’ ভূত?
স্থানীয়দের ভাষায়, গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল বা গুরুঙ্গের প্রশিক্ষিত যুব-বাহিনী জিএলপি-ই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মুখে হয়ে গিয়েছে জিলিপি। কে ভয় পায় না তাদের!
তৃণমূলের টিকিটে কার্শিয়াঙে প্রার্থী হয়েছেন জিএনএলএফ-এর ডাকসাইটে নেত্রী শান্তা ছেত্রী। এর আগে চার বার কার্শিয়াং থেকে বিধায়ক হয়েছেন তিনি। জিতেছেন ৮৫ শতাংশের বেশি ভোটে। একদা তাঁকে জেতাতে যে জিএনএলএফ নেতাকে আসরে দেখা যেত, সেই ইন্দ্রনারায়ণ প্রধান এখন নিজের খামার নিয়ে ব্যস্ত। বললেন, ‘‘ভোট-টোট নিয়ে আর ভাবি না। ভূত-টূত নিয়েও কিছু বলব না। তবে ভূতের ভয় কার না আছে!’’
মোর্চার উত্থানের পরে একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন ইন্দ্রনারায়ণ। ঘরদোর ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাঁর। প্রতিবারই জিএলপি-র দিকে অভিযোগের তির গিয়েছে। থানা-পুলিশ করতে করতে হেদিয়ে গিয়েছেন ইন্দ্রবাবু। শেষ পর্যন্ত ‘পার্টি-পলিটিক্স’ ছেড়েছুড়ে মন দিয়েছেন পশু-পাখি-খামারে। এখন বলছেন, ‘‘শান্তিতে আছি। শান্তাও শান্তিতে থাকুক।’’
সুবাস ঘিসিঙ্গের দলের যে নেতারা মোর্চায় যোগ দেননি, তাঁরা প্রায় সকলেই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। তৃণমূলকে সমর্থন করলেও পথেঘাটে খুব একটা দেখাই যাচ্ছে না তাঁদের।
কেন? দার্জিলিংয়ের ম্যাল চৌরাস্তায় পায়রাদের দানা ছড়ানোর ফাঁকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে এক জিএনএলএফ নেতা ফিসফিস করে বললেন, ‘‘বয়স হচ্ছে তো! এখন সকালে মিছিলে যাব। রাতে বাড়িতে ভূতে ঢেলা মারবে। সেটা আর ভাল লাগে না। পুলিশ-টুলিশকে বলে কোনও লাভ হয় না। আমরাও তো এ ভাবেই চালাতাম।’’ ভূত সামলানো যে চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, সেটা শুধু শান্তা নন, হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন দার্জিলিঙে তৃণমূলের প্রার্থী সারদা সুব্বাও। বুঝতে পারছেন কালিম্পঙের বিদায়ী বিধায়ক হরকাবাহাদুর ছেত্রীও।
মর্গান হাউস থেকে হরকার বাড়ি খুব দূরে নয়। রোজ ভোরবেলা কালিম্পং থানার পাশ দিয়ে ডম্বর চক হয়ে প্রাতর্ভ্রমণ করেন দার্জিলিঙের বিদ্বজ্জন সমাজের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। জিএনএলএফ-এর আমলে ভূতেদের দাপাদাপি স্বচক্ষে দেখেছেন তিনি। গত বারে মোর্চার প্রার্থী হিসেবে প্রায় ৮৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। সেই ভোটে কতটা জল ছিল? প্রশ্ন উঠলে বিষম খান জন আন্দোলন পার্টির (জাপ) দফতরে বসা অনেকেই।
হ্যাঁ, সম্প্রতি মোর্চা ছেড়ে এই দলটিই গড়েছেন হরকা। আর এ বার ভোটে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে। কিছুতেই নিতে চাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের টিকিট। তাঁর দলেরই দফতরে বসে তাঁরই শাগরেদদের কেউ কেউ জল আর ভূতের কথা শুনে হেসে ফেলেন। কেউ আবার বলেন, ‘‘পুলিশ-প্রশাসন ঠিক থাকলে আমরা ভূত তাড়িয়ে দিতে পারব। কিন্তু, আমাদের প্রার্থী তো শাসক দলের টিকিট নেননি। শুধু সমর্থন নিয়েছেন। তাই ভূত ঠেকাতে পুরো সাহায্য পাব কি?’’
অতীতে ঘিসিঙ্গের বিরুদ্ধে যে হাতে গোনা কয়েক জন মুখ খোলার সাহস দেখিয়েছিলেন, হরকা তাঁদের অন্যতম। কখনও ‘গম্ফু’স, কখনও ‘অন্নপূর্ণা’ রেস্তোরাঁ কিংবা কখনও ডম্বর চকের চায়ের দোকানে বসে জনে জনে বোঝাতেন, কেন ঘিসিঙ্গের বন্ধ রাজনীতির বিরোধিতা করা উচিত। ঘিসিঙ্গকে হটাতেই গুরুঙ্গের সঙ্গে সামিল হন। তার পরে ধীরে ধীরে মমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, এবং গুরুঙ্গের চক্ষুশূল হয়ে দলত্যাগ।
জাপ-এর লোকেরা বলছেন, তৃণমূল প্রার্থী না হওয়ায় কিন্তু একটা জায়গায় পিছিয়ে পড়েছেন হরকা। শান্তা-সারদারা শাসক দলের প্রার্থী হিসেবে সুবিধা পাচ্ছেন। ভোটে যদি হারেন, তাতেও তাঁদের জীবনে ছায়াময়দের হানাদারি রুখতে দল সাহায্য করবে বলে আশ্বাস পেয়েছেন।
আর উল্টো দিকে হরকার শিবির ভূত-দৌরাত্ম্যে বড়ই বিষণ্ণ। ডম্বর চক থেকে মর্গান হাউস লাগোয়া জনপদ, ‘জাপ’-এর নির্বাচনী কার্যালয়ে ‘বারো ভূত’-এর তাণ্ডব নিয়ে কত কথাই না শোনা গেল! কালিম্পঙের সবচেয়ে প্রাচীন গির্জার অদূরের বাগান থেকে বাড়ির পোষ্যের জন্য ঘাস কাটার ফাঁকে সুখবাহাদুর তামাঙ্গ বললেন, ‘‘ভূত তো আছেই। তাঁরা পাহাড়ে এক জনকেই ভয় পায়। সে হল বিমল গুরুঙ্গ। গুরুঙ্গ চাইলে ভূতদের কান ধরে ওঠবস করাতে পারেন।’’
বলেন কি! যা শুনে গুরুঙ্গ মুচকি হেসেছেন। কোনও কথা বলেননি। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা রোশন গিরি বলেন, ‘‘গুজবে কেউ কান দেয় না। সমতলে কোথায় ভূতেদের পোয়াবারো, গুড়-জলের রমরমা, দানা ছড়ানো হয়, তা দুনিয়ার লোক জানে। আমরা শান্তিপূর্ণ ভোট চাই।’’
যা শুনে আবার গোটা দার্জিলিং হাসছে।