নারদ-ভাইয়ের হাত ধরে দিদি। আরামবাগের সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ইকবাল আহমেদ। ছবি: মোহন দাস।
হুল বিঁধে তৃণমূল দু’ভাগ ছিলই। ওরা নারদ, আমরা নই।
নারদেও এ বার শুরু হল ‘আমরা-ওরা’!
হুলের জ্বালা থেকে ভাইদের বাঁচাতে দিদি যে কৌশল নিয়েছেন, তাতেই নারদ ভেঙে এখন ‘দুইখান’। একখান— নারদে অভিযুক্ত তৃণমূলের ছয় সাংসদ। যাঁদের মধ্যে রাজ্যসভার সাংসদ মুকুল রায় ছাড়া পাঁচ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে লোকসভার নীতি (এথিক্স) কমিটি। অন্যখান— নারদে অভিযুক্ত বিধায়ক-মন্ত্রীরা। যেমন ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ইকবাল আহমেদ, শোভন চট্টোপাধ্যায়, মদন মিত্ররা।
ভাগ হল কী ভাবে?
নারদ-অভিযুক্ত তৃণমূলের লোকসভার পাঁচ সাংসদ— সুলতান আহমেদ, সৌগত রায়, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী এবং কাকলি ঘোষ দস্তিদারকে সপ্তাহ তিনেক আগে নোটিস ধরিয়েছিল লোকসভার নীতি কমিটি। সুলতান ছাড়া সকলেই দাবি করেছিলেন, তাঁরা নোটিস পাননি। ভরা ভোটের বাজারে এ ভাবে ‘ও কিছু নয়’ বোঝানোর একটা চেষ্টা নেতারা করেই থাকেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মুখে তৃণমূল সাংসদরা এই কথা বললেও লোকসভাকে এড়ানোর সাহস দেখাননি কেউই। সৌগত, কাকলি, সুলতান— তলে তলে প্রায় সকলেই কমিটিকে নোটিসের জবাব পাঠিয়ে দিয়েছেন। শুক্রবার নিজের হাতে নোটিসের জবাব দিতে দিল্লি গিয়েছিলেন প্রসূন।
ব্যাপারটা এখানেই থেমে নেই। ঘুষ-কাণ্ডে অভিযুক্ত এক সাংসদ জানান, ‘‘নারদকে মোকাবিলার কৌশল ঠিক করে দিয়েছেন দিদিই। ওঁরই নির্দেশ, নীতি কমিটিকে এখন বলা হবে, ‘ভোট চলছে, তাই আমরা ব্যস্ত।’ ১৯ মে-র (ভোটের ফল প্রকাশের তারিখ) পরে কমিটিকে জবাব দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে হাইকোর্টে এ ব্যাপারে যে মামলা চলছে, সেখানে সাংসদরা পৃথক পৃথক ভাবে হলফনামা দিয়ে বলবেন, ‘আমরা এথিক্স কমিটির আন্ডারে’। সংসদ সবার উপরে। তাই নারদ নিয়ে ওই কমিটি যখন তদন্ত করছে, তখন আদালত পাঁচ সাংসদের বিষয়টি শুনানির আওতা থেকে বাদ রাখুক।’’
প্রশ্ন হল, সে ক্ষেত্রে নারদে অভিযুক্ত বিধায়ক-মন্ত্রীদের কী হবে? জবাবে ওই তৃণমূল সাংসদ সরল ভাবে বলেন, ‘‘ওঁদের ব্যাপারটা হাইকোর্টই দেখবে।’’ কেন? ওই সাংসদের যুক্তি, এখন বিধানসভা থেকেও নেই। ওই বিধায়কদের কেউ এ বারের ভোটে হারলে তো হয়েই গেল। কিন্তু কেউ নতুন বিধানসভায় জিতে এলেও সেখানে ‘অ্যাডহক কমিটি’ গঠন করে (লোকসভার নীতি কমিটির মতো) পুরনো বিধানসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাতে নীতিগত সমস্যা হবে। ওই সাংসদের কথায়, ‘‘এই কারণেই ওঁদের বিরুদ্ধে একমাত্র ফৌজদারি তদন্তটাই হতে পারে।’’
এই ভেদাভেদ নিয়েই তৃণমূলের ভিতরে এখন ‘আমরা-ওরা’র নতুন টানাপড়েন শুরু হয়েছে বলে সূত্রের দাবি। যদিও এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে চাননি। একমাত্র সৌগত রায় স্বীকার করেছেন, তিনি নীতি কমিটির কাছে জবাব পাঠিয়েছেন।
কংগ্রেস মুখপাত্র তথা বিশিষ্ট আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি অবশ্য বলেন, ‘‘তৃণমূল সাংসদরা যে ভাবে হাইকোর্টে হলফনামা পেশ করার কথা ভাবছেন, তা ধোপে টিকবে না। লোকসভার নীতি কমিটির তদন্ত চললেও সমান্তরাল বহুমুখী তদন্তে কোনও অসুবিধে নেই।’’ নীতি কমিটির এক সদস্য জানান, নারদের থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তৃণমূল সাংসদদের সদস্যপদ খারিজ করার সুপারিশ করতে পারে কমিটি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাতে ফৌজদারি বিচার হল না। ঘুষ নেওয়া আইনত অপরাধ। তাই ফৌজদারি দণ্ডবিধি মোতাবেক বিচার ও শাস্তির আশঙ্কা ওঁদের থাকছেই। কাজেই এখন সাময়িক ভাবে ‘আমরা-ওরা’ চললেও, আদতে ওঁরা সবাই সমান। সবাই একই নারদ-নৌকোর যাত্রী!
বিরোধী রাজনীতিকদেরও তা-ই মত। তাঁরা বলছেন, নারদে অভিযুক্ত ভাইদের মধ্যে দেওয়াল গড়ে উঠলেও দিদিকে কিন্তু এঁদের সকলকে সমান চোখেই দেখতে হবে। না হলে গোটা দলের বিপদ। ইতিমধ্যেই মুকুল বলেছেন, ‘টাকা নিলেও দলের জন্যই নেওয়া হয়েছে।’ ক্রমশ দেখা গিয়েছে, প্রথমে ঘুষ-কাণ্ডের থেকে নিজের দূরত্ব বাড়াতে চেয়েও পরে প্রকাশ্য সভায় নারদকে মেনে নিয়েছেন দিদি।
কী ভাবে? ‘কলঙ্কিত’ ভাইদের প্রার্থী করা নিয়ে বৌবাজারের সভায় প্রথমে তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন, ‘‘আগে জানলে নিশ্চয়ই ভাবতাম।’’ এই কথায় দলেই বিদ্রোহের পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে দিদিকে নামতে হয় ড্যামেজ কন্ট্রোলে। গত বুধবার দেখা যায়, বারাসতে দিদির সভায় স্থানীয় সাংসদ কাকলিই নেই। এ নিয়ে ফিসফাস শুরু হতেই পরের দিন আমডাঙার সভায় কাকলিকে ডেকে নেন দিদি। সভা শুরু করেন, ‘আমার প্রিয় কাকলি’ বলে। এর পরে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বলেন, ‘‘মায়ের পাঁচটা ছেলে থাকলে এক-আধটা
দুষ্টু হয়।’’
নারদ-প্রশ্নে দিদির অবস্থান নিয়ে দোলাচল কেটে যায় এই মন্তব্যে। তার পর শনিবার আরামবাগের সভাতেও দেখা যায়, একই সুরে গাইছেন তিনি। সভা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মঞ্চে তখন উপস্থিত অন্যতম নারদ-অভিযুক্ত, খানাকুলের প্রার্থী ইকবাল আহমেদ। আর মঞ্চ থেকে দিদি বলছেন, “তৃণমূল মানুষের দল। মা ছাড়া তৃণমূল চলে না, একটা ছেলে দুষ্টুমি করলে মা তাকে শাসন করবে, তাড়াবে না।”
নারদ কাণ্ড নিয়ে মামলা
নারদ কাণ্ডে অভিযুক্ত তৃণমূলের বিধায়ক ও সাংসদদের অপসারণ চেয়ে জনস্বার্থ মামলা হল সুপ্রিম কোর্টে। আবেদনকারী বিপ্লব চৌধুরীর তরফে শীর্ষ আদালতে অনুরোধ জানানো হয়েছে, যে সব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হোক। দোষী প্রমাণিত হলে তাঁদের বিধায়ক বা সাংসদ পদ খারিজের জন্য বিধানসভার স্পিকার, লোকসভার স্পিকার, রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিক আদালত। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে তাঁদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপরে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছেন আবেদনকারী। বিপ্লববাবুর আইনজীবী শুভাশিস ভৌমিক বলেন, আগামী সপ্তাহে মামলাটি বিচারপতির সামনে উল্লেখ করা হবে।