কয়লার গুঁড়ো মাখা বাতাসে এখন স্লোগানের ফোড়ন। কাছে সরস্বতী মন্দিরের মাঠ থেকে মাইকে ভেসে আসছে শুভেন্দু অধিকারীর মিটিংয়ের হুঙ্কার। ঘুম ভেঙে কেঁপে ওঠে ‘সোনা’। কাজলের টিপটা ঠিক আছে তো! ভয়ে-ভয়ে দেখে নেন মা।
রাতভর দস্যিপনার পরে যত ঘুম তো ভরসন্ধেয়। আগে ঘুম ভাঙলেই ডান হাতের আঙুলগুলো মুখে পুরত। ‘‘অপারেশনের পরে দেখতাম, ঘাড়টাড় বেঁকিয়ে সেই হাতটাই খুঁজছে। এখন ঠিক বাঁ হাতের আঙুল চিনে নিয়েছে,’’ সস্তার ছাপা শাড়ি-পরা ছোটখাটো দোহারা সদ্য-তরুণী একটু হাসেন। ভোটগ্রস্ত এই রাজ্যে যাঁর পরিচয়, অঙ্কুশ শীটের মা। আসানসোলের হাসপাতালের ‘ভুলে’ আড়াই মাসের যে শিশুর ডান হাতের গোটাটাই প্রায় উড়ে গিয়েছে। ছেলের এক হাতে আড়মোড়া ভাঙা দেখতে দেখতে পিউ শীট বলেন, ‘‘ইস্, কখনও গাড়ি চালানো হবে না সোনার। আমার মোটরবাইক যা ভাল লাগে! ভাবতাম ছেলেটা দেবের মতো হিরো হন্ডা চালাবে!’’
রানিগঞ্জ লাগোয়া বল্লভপুরের পুরাতন ডাকঘর মোড়ের কাছে নিম্নবিত্ত সংসার। চিলতে খাটে উপুড় হওয়া শিশুর এক হাতে চিত হওয়ার যুদ্ধ। বাইরে ভোটযুদ্ধের মিটিং। তার চিল-চিৎকারের নীচে মায়ের ভয়-পাওয়া গলা শোনা যায়। ‘‘এক হাতে জোর পাচ্ছে না, দেখছেন? উপুড় থেকে চিত হওয়া, হামা দেওয়া, ঠিকঠাক পারবে তো? ’’ এ বার চোখ ফেটে জল আসে পিউয়ের— ‘‘আমার হাত-কাটা ছেলের হাঁটতে শেখাও কি পিছিয়ে যাবে?’’
রানিগঞ্জ-বল্লভপুরের দেওয়াল জুড়ে শাসক দলের ‘এগিয়ে থাকা’র অহঙ্কার— ‘চকচকে রাস্তা, ঝকঝকে আলো/ জনগণ বলছে তৃণমূলই ভাল।’ তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর ‘গর্বের’ সরকারি হাসপাতালে কী করে ঘটল এমন ঘটনা? স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা বিরক্ত হন, ‘‘আঃ, হচ্ছে তো তদন্ত! দু’জন করে নার্স-ডাক্তার সাসপেন্ড আছেন।’’ ব্যাখ্যা পেশ হয়, আসানসোল মহকুমা হাসপাতালের ওয়ার্ডময় ৭০-৮০টা বাচ্চা ছিল তখন। বেডে-বেডে এক জোড়া শিশু ও মা। নার্স মোটে দু’জন।
ওহ্, সেই চাপেই তা হলে রক্ত নেওয়ার পরে অঙ্কুশের হাতে বাঁধা রবারের নলটা খুলতে ভুলে গিয়েছিলেন নার্স? দু’দিন বাদে যখন চোখে পড়ল, রক্ত চলাচল থমকে হাতটা তখন পচে কালো হয়ে গিয়েছে। তড়িঘড়ি কলকাতা নিয়ে গিয়ে সেই কচি হাত কেটে বাদ দিতে হল। প্রশ্ন অনেক। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর এখনও বলতে পারেনি, ভুলটা ঠিক কার। আসানসোলের নার্স-ডাক্তাররা অবশ্য মায়ের দিকেই আঙুল তুলে বলেছিলেন, নল যে খোলা হয়নি, সেটা তিনি খেয়াল করেননি কেন!
দিনটা ছিল ২৬ জানুয়ারি। সারাদিন কেমন যেন করছিল ছেলে। এ দিকে গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে নার্সিংহোম— ছুটির দিনে কোথাও ডাক্তার নেই। নিউমোনিয়ায় কাহিল একরত্তিকে অগত্যা আসানসোলের মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল। নেওয়া হল রক্ত।
পিউ আবার কাঁদেন, ‘‘কী করে বুঝব বলুন! শীতকালে সোনার গায়ে তখন তিন-তিনটে জামা, হুডওয়ালা জ্যাকেট। ওঁরা বলছিলেন, একটুও ঠান্ডা যেন না-লাগে।’’ রক্ত নেওয়ার পরে নীচের জামাটা নামিয়েই গরম জামা পরিয়ে দিতে বলেছিলেন নার্স। দু’দিন বাদে হাতের তেলোটা কালো হচ্ছে দেখেও কেউ পাত্তা দেননি। কিছু না-দেখেই একটা মলম লাগাতে দেন ডাক্তারবাবু। সেই মলম লাগানোর সময়ে জামা তুলতেই দেখা যায়, গোটা হাতটাই কালো! তার পরেই চোখে পড়ে নলটা। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে তত দিনে।
এর পরেও সইতে হয়েছে সরকারি নিস্পৃহতা। কলকাতার ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন, ছেলের বয়স বছর চার-পাঁচ হলে, নকল হাত বসানোর দায়িত্ব নেবে সরকারই। কিন্তু কী ভাবে? কেউ তো লিখে দেয়নি কিছু! নামী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে বলেন, ছোটদের এমন কিছু ঘটলে মা-বাবার নিয়মিত কাউন্সেলিং দরকার। একটু বড় হলে বাচ্চাটাও বুঝবে, ওর কী ঘটেছে। তখনও তার মনের ক্ষতও সারাতে হবে যত্ন করে!
রোজকার বাঁচার লড়াইয়ে জেরবার ঘরে এ-সব ভাবনা বড্ড বিলাসিতা মনে হয়। অপারেশনের এক মাস বাদে তবুও কলকাতার পিজি হাসপাতালে বাচ্চাকে নিয়ে গিয়েছিলেন মা-বাবা। ‘‘অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পরে এক বার দেখেই আমাদের চলে যেতে বলল। নতুন হাত নিয়েও কিছু বলল না কেউ’’— জড়োসড়ো হয়ে বলেন পিউ। পৌঁছেছিলেন কালীঘাটেও। দেখা করেননি কেউ।
মাসখানেক আগে বল্লভপুরে বাসস্ট্যান্ড উদ্বোধন করতে এসে অবশ্য অঙ্কুশদের বাড়িটা ঘুরে গিয়েছিলেন আসানসোল (দক্ষিণ) কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোটপ্রার্থী তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। বলে গিয়েছিলেন, ‘‘দেখি, দিদির কানে কী করে সব তোলা যায়!’’ আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি এসে অবশ্য টিভি-ক্যামেরার সামনেই প্রায় চাকরি দিয়ে ফেলেছিলেন হতভাগ্য শিশুর বাবাকে। তার পরে আর রা-টি কাড়েননি। বিরোধী দলের লোকজন হাসপাতালে বিক্ষোভ দেখিয়েছে, স্বাস্থ্য দফতরের গাফিলতি নিয়ে পোস্টার মেরেছে! ছিটেফোঁটা সাহায্য কেউ করেনি। কাগজে-টিভিতে হইচই, হাসপাতালে বিক্ষোভের পর নবান্ন থেকে একটা চিঠি অবশ্য এসেছে। বাচ্চার নামে এক লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজ। ওটাই প্রায়শ্চিত্ত। দশ বছর বাদে দ্বিগুণ হবে টাকাটা।
তাতে চলবে? ‘‘পোড়া কপাল, ছেলেটাকে কী ভাবে মানুষ করব’’— ভেবে কাহিল বেঁটেখাটো ক্ষয়াটে যুবক। অঙ্কুশের বাবা জয়ন্ত শীট। বাস কন্ডাক্টরের ডিউটিতে মাসে দেড় হাজারও জোটে না সচরাচর। রানিগঞ্জ থেকে উখড়া, পাণ্ডবেশ্বর, দুর্গাপুর
পাড়ি দিয়ে ১২ ঘণ্টা ডিউটি সেরে ধুঁকতে ধুঁকতে ফেরেন সন্ধ্যায়। স্বামীর দিকে তাকিয়ে পিউ বলেন, ‘‘ও বড় সাদাসিধা। আমরা কেউই তো পড়াশোনা শিখিনি বেশি!’’
এখন ছেলের সর্দি হলেই অস্থির হন মা। পেটের গোলমালে ক’দিন আগেই ফের যেতে হল আসানসোলের হাসপাতালে। ওরা ফের রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেছিল। শুনেই ফিরে এসেছেন। পিউ বলেন, ‘‘ছেলের রক্ত পরীক্ষার কথা শুনলেই আমার বুক কাঁপে।’’ কাজলের টিপ তাই গাঢ় হয়। ছেলের গোড়ালিতে আঁটো করে কালো সুতো বাঁধেন মা।
ভাগ্যের হাতে সব সঁপে দেওয়া অসহায় পরিবারেই তাক করে ভোটের পাখিরা। সদ্য আঠারো পার করা পিউয়ের এখনও ভোটের খাতায় নাম তোলা হয়নি। বল্লভপুর পেপারমিলের তৃণমূল ইউনিয়নের নেতারা জয়ন্তকে ডাকেন। বলেন, ‘‘সকাল-সকাল ভোটটা দিতে যাস!’’ প্যাংলা কন্ডাক্টর শুধু ঘাড় নাড়েন। আর নিঃশব্দে তাকান ছেলের দিকে। প্রতিকারহীন অপরাধের সামনে কী-ই বা করার! মাইকে ফের স্লোগান ভাসে। এক হাত নেড়ে খলখল হাসে দুধের শিশু। গুলিয়ে যায়, ভোট ও ভবিষ্যৎ!