বিপন্ন ইটভাটাই অস্ত্র জোটের

এলাকার অর্থনীতি অনেকটাই দাঁড়িয়ে ইটভাটা শিল্পের উপর। রূপনারায়ণ আর দামোদরের পাড় জুড়ে নয় নয় করেও ভাটার সংখ্যা অন্তত দেড়শো। অভিযোগ ছিল পরিবেশবিধির তোয়াক্কা না করেই চলছিল সে সব।

Advertisement

নুরুল আবসার

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৬ ০২:১৮
Share:

এলাকার অর্থনীতি অনেকটাই দাঁড়িয়ে ইটভাটা শিল্পের উপর। রূপনারায়ণ আর দামোদরের পাড় জুড়ে নয় নয় করেও ভাটার সংখ্যা অন্তত দেড়শো। অভিযোগ ছিল পরিবেশবিধির তোয়াক্কা না করেই চলছিল সে সব। সম্প্রতি জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়ে বিপাকে পড়েছে সেই ইটভাটা শিল্প। পরিবেশ বিধি না মানার অপরাধে বন্ধ হয়েছে বেশরভাগ ভাটা। আর এমন অবস্থার জন্য শাসক দলকেই কাঠগড়ায় তুলেছে ভাটা মালিক এবং শ্রমিকেরা। হাওড়ার শ্যামপুর বিধানসভার ভোটে যে এ বার এই ইটভাটা শিল্পের প্রভাব ভালই পড়বে বলে তা নিয়ে একমত স্থানীয় রাজনৈতিক মহল।

Advertisement

ভাটা মালিকদের বক্তব্য, তাঁদের এ হেন পরিস্থিতির জন্য রাজ্য সরকার দায়ী। কারণ, পরিবেশ বিধি মানার ক্ষেত্রে তারা ভাটাগুলিকে সে ভাবে সতর্ক করেনি। পরিবেশ আদালতের কড়াকড়ির সামনে পড়ে তাঁদের রুজি বন্ধের জোগা়ড়। প্রায় তিরিশ হাজার শ্রমিক বিপন্ন। অথচ সরকার সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলেছে। এমনকী পরিবেশ বিধি মানতে আদালতের কাছে সময় চেয়ে তাঁদের আবেদনের সময়ও পাশে পাওয়া যায়নি রাজ্য সরকারকে। ভাটাশ্রমিক সংগঠনের তরফে সিটু নেতা উত্তম রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘বিকল্প শিল্প এখানে নেই। ভাটার শ্রমিকেরা কাজ পাচ্ছেন না। শ্যামপুরের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে।’’ একই কথা টিইউসিসি নেতা অসিত সাউয়ের। এই অবস্থায় ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকদের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলকে বেকায়দায় ফেলতে কোমর বেঁধেছে বাম-কংগ্রেস জোট।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে এ বার জোটের প্রার্থী কংগ্রেসের। যদিও গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এখানে কংগ্রেসের ভোট বেশ কম। তূলনায় অনেক বেশি বামফ্রন্টের ভোট। তবুও জোটের স্বার্থে কংগ্রেস প্রার্থীকে সামনে রেখে লড়াইয়ে নেমেছে বামেরা। জোটসঙ্গী হিসাবে বামেরা কংগ্রেসের মুখোশ পরলেও আসল লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে বামফ্রন্টেরই। বকলমে ফরওয়ার্ড ব্লকের। কারণ বরারবর বামফ্রন্টের হয়ে তারা এই আসনে লড়াই করেছে। আর তাই এ বার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের ‘সিংহ’ প্রতীকের বদলে ‘হাত’-এ ভোটারদের অভ্যস্ত করতে তাঁদের বলতে হচ্ছে, ‘মনে করুন আমরাই লড়ছি, প্রতীকটাই শুধু বদলেছে’।

Advertisement

২০০১ থেকেই শ্যামপুর জেলায় তৃণমূলের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি। এবারের প্রার্থী কালীপদ মণ্ডল ২০০১ থেকে এখানকার বিধায়ক। প্রথমে জিতেছিলেন জোটপ্রার্থী হিসাবে। ২০০৬ সালে ভেঙে যায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। তাও একক শক্তিতে বাজিমাত করেন তিনি। ২০১১য় ফের কংগ্রেসের সঙ্গে জোট এবং ফের জয়ী। তার উপর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের নিরীখে প্রায় ৩১ হাজার ভোটে বামপ্রার্থীর থেকে এগিয়ে।

আর বামেদের জোটসঙ্গী কংগ্রেসের কি অবস্থা?

২০০৬ সালে এখানে কংগ্রেস ভোট পেয়েছিল ৫২৫২টি। ২০১৪ র লোকসভায় এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের ভোট ছিল ৬১৭৬টি। ভোটের পরিসংখ্যানই বলছে কালীপদবাবুর সামনে ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে।

তা হলে লড়াইটা কোথায়?

২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে তৃণমূল পেয়েছিল ৯৯, ৫০২টি ভোট। ফরওয়ার্ড ব্লক পেয়েছিল ৬৪, ৮৮২টি ভোট। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা যায়, তৃণমূলের ভোট কমেছে। তারা পেয়েছে ৯৫, ৮০৩টি ভোট। অন্য দিকে ভোট বাড়ে বামফ্রন্টের। তারা পেয়েছিল ৬৬, ৯৫১টি ভোট। গত লোকসভায় কংগ্রেস পেয়েছিল ৬১৭৬টি ভোট। দু’টি ভোট একসঙ্গে ধরলে তৃণমূলের সঙ্গে ব্যবধান দাঁড়ায় ২২ হাজারে। ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে তৃণমূল ফরওয়ার্ড ব্লককে হারিয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ভোটে। কংগ্রেসের ভোট বাদ দিলেও সেই ব্যবধান ছিল প্রায় ২৯ হাজার। সেই হিসাবে ২০১৪র লোকসভার হিসাবে তৃণমূলের সঙ্গে বামফ্রন্টের ব্যবধান স্পষ্টত কমেছে। শুধু তাই নয়, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলার মধ্যে বামফ্রন্ট একমাত্র শ্যামপুর ১ ব্লকেই ভাল ফল করে। দু’টি পঞ্চায়েত দখল করে তারা। বাকিগুলিতেও খুব কম ব্যবধানে হারেন বামপ্রার্থীরা।

কংগ্রেসকে এই কেন্দ্র ছাড়া নিয়ে জেলা বামফ্রন্টের এক নেতা জানান, ফরওয়ার্ড ব্লককে এই আসন দিলে অনেক গোঁড়া কংগ্রেস সমর্থক জোট প্রার্থীকে ভোট নাও দিতে পারতেন। বামফ্রন্ট যেহেতু শৃঙ্খলাবদ্ধ দল তাই উপরতলার সিদ্ধান্ত মেনে তাদের ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া নিয়ে সমস্যা হবে না। ফলে জোটের একটিও ভোট নষ্ট হবে না। উল্টে তৃণমূলের অনেক বিক্ষুব্ধ ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে আসতে পারে বলে ওই নেতার ধারণা। একই মত জেলা কংগ্রেস নেতৃত্বের। পাশাপাশি জোটপ্রার্থী অমিতাভ চক্রবর্তী জোর দিচ্ছেন চলতি নানা ইসু সারদা, নারদ, বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে পড়ার মতো ঘটনাকে যা শাসকদলকে বেশ কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে। সর্বোপরি ইটভাটা নিয়ে ভাটামালিক ও স্থানীয় শ্রমিকদের ক্ষোভকেও হিসাবে রাখছে জোট। এ সব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বিঁধতে নাম ঘোষণার পরদিন থেকেই কলকাতার বাস ছেড়ে শশাটিতে ঘাঁটি গেড়েছেন অমিতাভবাবু। দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছুটছেন। সঙ্গে রয়েছেন সিপিএম এবং ফব কর্মীরা। জোটপ্রার্থীর কথায়, ‘‘শ্যামপুর বেঁচে আছে ইটভাটার উপরে। বহু মানুষের রুজির প্রশ্ন জড়িত। অথচ সেগুলি ধ্বংস হতে বসেছে তৃণমূল বিধায়কের অকর্মণ্যতার জন্য।’’

বসে নেই কালীপদবাবুও। সকাল-বিকেল পদযাত্রা করছেন তৃণমূলের বর্ষীয়ান বিদায়ী বিধায়ক। সারদা ও নারদ কাণ্ড যে গ্রামাঞ্চলে কোনও প্রভাব ফেলবে না বলে সে বিষয়ে ষথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী তিনি। আর ইটভাটা নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘মনে রাখতে হবে, ইটভাটাগুলির সার্বিক উন্নয়ন তৃণমূলের আমলেই হয়েছে।’’ সেইসঙ্গে কংগ্রেসের ‘মুখোশ’ পরে বামফ্রন্টের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টাকে কটাক্ষ করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘সিপিএমের হাত ধরার জন্য কংগ্রেসের লজ্জা হাওয়া উচিত। এর ফলে কংগ্রেসের সব ভোট আমাদের বাক্সেই পড়বে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement