জোটের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে মানভূমেই

পাঁচে পাশ, চারে ফেল, ছয় মানে কি খতম খেল! শুনলে হেঁয়ালির মতো লাগতে পারে। জটায়ু থাকলে বলতেন, ‘পাগল নাকি?’ ফেলু মিত্তিরের সে স্বভাব নয়। নির্ঘাত ভাবতেন, ভোটের বাজার। রহস্যটা কী তোপসে?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৫০
Share:

সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জওয়ান। বাঘমুন্ডির মাঠা ভোটকেন্দ্রে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

পাঁচে পাশ, চারে ফেল, ছয় মানে কি খতম খেল!

Advertisement

শুনলে হেঁয়ালির মতো লাগতে পারে। জটায়ু থাকলে বলতেন, ‘পাগল নাকি?’ ফেলু মিত্তিরের সে স্বভাব নয়। নির্ঘাত ভাবতেন, ভোটের বাজার। রহস্যটা কী তোপসে?

দেখা যাক। পুরুলিয়ায় ৯টি আসনেই ভোট হয়ে গিয়েছে সোমবার। বিক্ষিপ্ত টুকটাক ঘটনা ছাড়া মোটের ওপর ভোট ছিল শান্ত। বিরোধীদের মধ্যেও তেমন অসন্তোষ নেই। বুথের সঠিক ঠিকানা না-দিলেও অধীর চৌধুরী টেবিল ঠুকে বলছেন, পুরুলিয়ায় অন্তত একশো বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি তৃণমূল। এমন কী হল ভোটে? ভোটের মেশিনের হার্ড ডিস্কে যাই লেখা থাকুক, মনে করা হচ্ছে, পুরুলিয়ার এই ভোটেই লিটমাস পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে জোটের।

Advertisement

কী ভাবে?

লোকসভা ভোটে বাম-কংগ্রেস জোট ছিল না। লড়াই ছিল চতুষ্কোণ। ভোটের পর দেখা গিয়েছে, দিদির ভোট ও জোটের ভোট ছিল সমান-সমান। পুরুলিয়ার ৯টি আসনের মধ্যে পাঁচটি আসন পুরুলিয়া, জয়পুর, বাঘমুন্ডি, পাড়া ও বলরামপুরে বাম-কংগ্রেসের সমষ্টিগত ভোট ছিল দিদির ভোটের থেকে বেশি। বিশেষ করে বাঘমুন্ডি আসনে দিদির থেকে পঞ্চাশ হাজার বেশি ছিল বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোট। ফলে পুরুলিয়ায় পাঁচটি আসনে যদি জোট জিতে যায়, বুঝতে হবে সূর্য-অধীর পাশ করছেন। তার কম হলেই ধরে নিতে হবে ডাহা ফেল। আবার ২০১৪-র ভোটে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে জোটের থেকে দিদির ভোট ছিল মাত্র পাঁচশো বেশি। ফলে সেই আসনটিও যদি এ বার জোটের খাতায় জোড়ে, তা হলে বুঝতে হবে শুধু পাশ নয়, ফার্স্ট ডিভিশন পাচ্ছেন তাঁরা। অর্থাৎ জোট রয়েছে তা-ই নয়, তার হাওয়াও জোরালো।

পুরুলিয়া-সহ জঙ্গলমহলের যে ১৮টি আসনে প্রথম দফায় ভোট হয়েছে, তার মধ্যে রানিবাঁধ ও তালড্যাংরাতেও লোকসভা নির্বাচনে দিদির থেকে বেশি ছিল জোটের ভোট। জোটের চোরা হাওয়া থাকলে সেখানেও শাসক দলের ফল ভাল হওয়ার কথা নয়। প্রশ্ন হল, মানভূমের মাটিতেই জোট-ধান ফলে গেলে বাকি বাংলায় কী হবে? কারণ, ববি হাকিমদের মতই হল, জঙ্গলমহলে ‘আমরা আছি আর মাওবাদীরা।’ তাই ভোটটা করিয়ে নেওয়া ওখানে সহজ।

ভোটমেশিনে সোমবার কী হিসেব জমা হয়েছে, তা এখনই জানা সম্ভব নয়। তবে ঘটনা হল, পুরুলিয়া থেকে আলিমুদ্দিনে যে রিপোর্ট আসছে তা জোট রসায়ন নিয়ে বাম শিবিরে আস্থা বাড়াচ্ছে। অনিল বিশ্বাসের জমানায় নিচু তলা থেকে যে রিপোর্ট আসত, তাতে মাটির গন্ধ থাকত। সিপিএমে সেই মেকানিজম অবশ্য এখন নেই। তবু এ-ও বাস্তব, যে পুরুলিয়ার রিপোর্ট হাতে নিয়ে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, প্রথম বলেই ছক্কা মেরেছে মানুষ। নেপাল মাহাতোদের কাছ থেকে অধীরদের পাওয়া হিসেবের সঙ্গেও তা মিলে যাচ্ছে। বিপরীতে শাসক শিবিরে হিসাবের নানা মত রয়েছে।

বিরোধীদের মতের সঙ্গে অবশ্য প্রবল আপত্তি করছেন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়। তাঁর মতে, ‘‘পুরুলিয়ায় যা ভোট হয়েছে তাতে পাশ তো দূর, অতি কম নম্বর পেয়ে ফেল করবে জোট।’’ দিদির দলের অনেকের এ-ও দাবি, ২০০৬ সালে তাঁরা এই ভুলটাই করেছিলেন। ভোট শান্তিপূর্ণ হচ্ছে দেখে ভেবেছিলেন এ বার জিতবেন বুঝি। আদতে ডাহা হারেন দিদি। পুরুলিয়ার ভোট দেখে এ বার সেই ভুলটাই করছে জোট।

শাসক দলের এই তত্ত্বেও অবশ্য গলদ রয়েছে। ২০০৬-এর ভোটে তৃণমূল একা লড়েছিল। নির্বাচনের পর কংগ্রেস ও তৃণমূলের ভোট যোগ করে দেখা যায়, তাঁদের জোট থাকলে ৯০টি আসন কমে যেতে পারত বামেদের।

এ সবের পরেও হেঁয়ালি-ছড়ায় একটা অঙ্ক ধরা নেই। তা হল বিজেপির ভোট। ২০১৪-র ভোটে পুরুলিয়ায় সাংঘাতিক কিছু ভোট পায়নি বিজেপি। যেটুকু পেয়েছিল, সেই ভোট তারা ধরে রাখতে পারবে কি না বা তাদের ঘর ভাঙবে কি না, সেও একটা বিষয়। মনে করা হয়, লোকসভা ভোটের সময় দিদি-বিরোধী দলগুলির ওপর আস্থা হারিয়ে নরেন্দ্র মোদীর দিকে ঝুঁকেছিলেন কিছু মানুষ। সেই ভোট তাই প্রতিবাদীর ভোট। এবং প্রতিবাদীর ভোট এ বারও প্রধান প্রতিবাদীর ঘরে যাবে।

সব মিলিয়ে তাই বলা যায়, জোটের লিটমাস পরীক্ষাটা হয়ে গিয়েছে পুরুলিয়ায়। হেঁয়ালিটাও এত ক্ষণে ধরে ফেলেছেন ফেলু মিত্তির।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement