আয়োজনে কোনও ত্রুটি রাখেননি তিনি। তবু কাজ হচ্ছে কই! রাজ্যের প্রথম দু’দিনের ভোট নিয়ে বিরোধী দলগুলির তীব্র অসন্তোষের মুখে দাঁড়িয়ে নিজেই এমন প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী। বৃহস্পতিবার সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কমিশনের ফুল বেঞ্চ নিয়ে তিনি কলকাতায় এসেছেন। মুখ্য নির্বাচনী অফিসার ও রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে সারা দিন বৈঠক করে তাঁদের কার্যত ভর্ৎসনা করেছেন। তার পর দিল্লি ফেরার আগে অবাধ ভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবারও কিছু কড়া পদক্ষেপের কথা শুনিয়ে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনার চ্যালেঞ্জ কমিশন গ্রহণ করেছে।’’
কী করবে কমিশন?
কার্যত বিরোধীদের অভিযোগকে মান্যতা দিয়ে নির্বাচন কমিশন জানান, সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দৃশ্যমানতা নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে কমিশন ঠিক করেছে, রবিবার দ্বিতীয় দফার নির্বাচন থেকে অন্তত ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ভোটের ডিউটিতে থাকবে। তারা শুধু বুথ নয়, ভোট কেন্দ্র ও তার আশপাশেও তারা থাকবে।
কিন্তু বিরোধী ভোট আটকাতে ভোটের এক-দু’দিন আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় যে শাসানি চলছে? জৈদীর দাওয়াই, ‘‘সিআরপি-র দেড় হাজার মোবাইল ভ্যান এলাকায় এলাকায় ঘুরে বেড়াবে।’’ কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি বোঝাতে তাদের গাড়ির সামনে হুটার লাগাতে বলেছেন তিনি। সেই সঙ্গে ‘কেন্দ্রীয় বাহিনী’ লেখা ফ্লেক্স। আর বুথের ভিতর ভূতুড়ে ভোট আটকাতে প্রশাসনকে তাঁর নির্দেশ, ‘‘যতটা সম্ভব বেশি বুথে সিসিটিভি এবং ওয়েব ক্যামেরার ব্যবস্থা করুন।’’ বুথের মধ্যে কোনও গোলমাল হলে, এজেন্টকে মারধর করা হলে রাজ্য পুলিশ নয়, ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় বাহিন। এর পরেও জেলাশাসক ও এসপি-দের কাছে জৈদীর নির্দেশ, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায় পাঠাতে হবে, দু’এক দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলিকে বৈঠকে ডেকে তা ঠিক করুন। পাশাপাশি, আপনারা কোথায় কোথায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পাঠাচ্ছেন, সেটাও ওদের জানিয়ে দিন।’’
কেন্দ্রীয় বাহিনীর মতো কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের নিয়েও বিস্তর অভিযোগ বিরোধীদের। তার মধ্যে অন্যতম দরকারের সময় ফোনে না-পাওয়া। এ দিন বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও মালদহের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক ও পুলিশ পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে আলাদা বৈঠকে বসে ফুল বেঞ্চ। সেখানে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়, ভোটের আগে-পরে যেন তাঁদের ফোনে পাওয়া যায়। এই নিয়ে কোনও অভিযোগ যেন না ওঠে।
ভোট-পরবর্তী রাজনৈতিক সংঘর্ষ নিয়েও কড়া অবস্থান নিয়েছেন জৈদী। সরাসরি রাজ্যের পুলিশ প্রধান (ডিজি)-কে তিনি বলেছেন, ‘‘প্রতিটি ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ করে কড়া ব্যবস্থা নিন।’’
তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন হলেও পশ্চিমবঙ্গের ভোট নিয়ে অনেক অভিযোগ। এতে কি প্রমাণিত হয় না যে এ রাজ্যে ভোট পরিচালনায় কমিশন ব্যর্থ হয়েছে? জৈদীর জবাব, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে ভোট পরিচালনা করা সব সময়ই চ্যালেঞ্জ। কমিশন সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে।’’
রাজ্যের এ বারের ভোটকে যে অন্য চোখে দেখছে কমিশন, সে কথা প্রথম থেকেই দিল্লির নির্বাচন সদন জানিয়ে এসেছে। ভারী সংখ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী থেকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ, পক্ষপাতিত্ব ও অন্যান্য অভিযোগে কলকাতার পুলিশ কমিশনার-সহ রাজ্যের কয়েক জন অফিসারকে সরিয়ে দেওয়া, ভোট শুরুর আগেই কমিশনের ফুল বেঞ্চের দু’বার কলকাতায় ঘুরে যাওয়া— বিরোধীদের কাছে ২০১১-র স্মৃতি উস্কে দিয়েছিল। কিন্তু জঙ্গলমহল ও বর্ধমানের শিল্পাঞ্চলে প্রথম দু’দিনের ভোট শেষে সেই বজ্র আঁটুনিতে বিস্তর ফাঁকফোঁকর খুঁজে পেয়েছে বিরোধীরা।
অভিযোগ অনেক, তার মধ্যে কয়েকটি বেশ গুরুতর। যেমন— পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও কেন তাদের রাস্তায় দেখা যাচ্ছে না? গোলমালের জায়গায় কেন পৌঁছচ্ছেন না পর্যবেক্ষকেরা? দ্বিতীয় দিনের ভোটে মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে কী করে ১৮০০ অভিযোগের নিষ্পত্তি করল মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতর? অথবা, দ্বিতীয় দিনের ভোটে কোনও গোলমাল না-হলে বন্দুক হাতে লোকজনকে ভোট কেন্দ্রের আশপাশে ঘুরতে দেখা গেল কী করে?
আগে তো বটেই, এ দিনও কমিশনের ফুল বেঞ্চের কাছে এমন সব অভিয়োগ জানিয়েছেন রাজ্যের প্রধান তিন বিরোধী দল এবং ‘সেভ ডেমোক্রেসি’ সংগঠনের সদস্যরা। বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের অপসারণ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। রাজ্যে বিজেপির সহ পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেছেন, ‘‘মুখ্য নির্বাচনী অফিসার ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।’’ বুথের ভিতর রাজ্য পুলিশের প্রবেশ নিয়েও অভিযোগ জানিয়েছেন সিদ্ধার্থ। কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া দাবি করেছেন, বীরভূমের পুলিশ সুপার এবং মালদহ ও মুর্শিদাবাদের জেলাশাসককেও অপসারণ করা হোক। মানসের অভিযোগ, কিছু জেলাশাসক মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ওঠাবসা করেন। মুখ্য নির্বাচনী অফিসার এবং উপ-নির্বাচন কমিশনারের কাজেও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
‘সেভ ডেমোক্রেসি’র পক্ষে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেন, ‘‘বিগত বছরগুলিতে ভোটে এমন হিংসা দেখিনি।’’ বিকাশ ভট্টাচার্য অভিযোগ করেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পালনে ব্যর্থ।’’ এর উল্টো দিকে তৃণমূলের পক্ষে মুকুল রায় ও সুব্রত বক্সী দাবি করেন, ‘‘৮৮৯৪টি বুথের মধ্যে মাত্র ১২টিতে হিংসার ঘটনা ঘটেছে। এক দল লোক এটাকেই বড় করে দেখিয়ে মানুষের রায়কে অগ্রাহ্য করছে। এটা আসলে মানুষের অপমান।’’