সেই মিছিলের ছবি মোবাইল ফোনে ধরে রাখছেন এক উৎসাহী। শুক্রবার ভবানীপুরে ছবিটি তুলেছেন দেশকল্যাণ চৌধুরী।
প্রশ্ন শুনে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু এক দিন উত্তেজিত হয়ে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘যৌথ প্রচার বলে কিছু হবে না!’’ জেলা থেকে কর্মীদের ফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের প্রবল প্রতিক্রিয়ায় ভেসে গিয়েছিল আলিমুদ্দিন।
তার কয়েক দিন পরেই পশ্চিম মেদিনীপুরের দশগ্রামে পথে নামলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর হাতে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়ার হাত। কংগ্রেস কর্মীরা সংবর্ধনা দিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদককে। আর সূর্যবাবুও সবংয়ের কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুঁইয়াকে জেতানোর আবেদন জানালেন।
অপেক্ষাতেই ছিলেন বাম ও কংগ্রেসের নিচু তলার কর্মী-সমর্থকেরা। সূর্যবাবু সঙ্কেত স্পষ্ট করে দেওয়ার পরেই বাঁধ ভেঙে গেল! তার পর থেকে প্রতি দিনই রাজ্য জুড়ে এখন বাম-কংগ্রেসের যৌথ প্রচার চলছে আপন গতিতে!
তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, কোন দিন কোন মিছিলে কার সঙ্গে কে যাবেন, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট বা বিধান ভবন থেকে কেউ বলে দিচ্ছে না! নিজেদের এলাকায় দু’পক্ষের নেতা-কর্মীরা নিজেরা ঠিক করে নিচ্ছেন, তৃণমূলকে আটকাতে কতটা পথ তাঁদের একসঙ্গে হাঁটতে হবে! সেই যৌথ পথ অতিক্রমে কোথাও প্রার্থীরা সঙ্গে থাকছেন, কোথাও আবার শুধু কর্মীরাই দু’তরফের পতাকা নিয়ে বেরোচ্ছেন। তৃণমূল স্তর থেকে উঠে-আসা তাগিদ এ ভাবে দুই পক্ষের যাবতীয় রাজনৈতিক ছুঁৎমার্গ সরিয়ে ফেলে বৃহত্তর জোটের বাতাবরণ তৈরি করে দিয়েছে— এমন ঘটনা বাংলার নির্বাচনী রাজনীতিতে অভূতপূর্ব!
নতুন অভিজ্ঞতার কথা বোঝাতেই সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলছেন, ‘‘এ রাজ্যে এটা সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি। নেতা-নেত্রীরা কিছু চাপিয়ে দেননি। মানুষ জোট বেঁধেছেন।’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘এত দিন বামফ্রন্টের জন্য ভোট চেয়েছি। এই প্রথম রাজ্যটাকে বাঁচানোর জন্য সবার কাছে ভোট চাইছি!’’ আর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মত, ‘‘দু’টো দলের মধ্যে রাজনৈতিক মতের পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু এখন মানুষের দাবিতে সে সব সরিয়ে দু’পক্ষের সমঝোতা হয়েছে। তৃণমূলকে হারাতে হবে, এটাই এখন আমাদের সকলের লক্ষ্য।’’
এই লক্ষ্য সামনে রেখেই আপাতত জমে উঠছে যৌথ প্রচার। ভোটের দিন যত কাছে আসছে, তত বেশি এলাকায় একসঙ্গে মাঠে-ময়দানে দেখা যাচ্ছে লাল ও তেরঙা পতাকা। বিধাননগরে অরুণাভ ঘোষের জন্য আসরে নেমেছে গোটা সিপিএম। চাঁপদানিতে আব্দুল মান্নানের সঙ্গে হাঁটছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের নরেন চট্টোপাধ্যায়। আবার হাজরায় দলের সভা থেকে গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষে জোরালো সওয়াল করছেন সিপিএমের সেলিম। যে কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী দীপা দাশমুন্সি। এবং যাঁকে দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে হারিয়েছিলেন সেলিমই! এখন অভিন্ন লক্ষ্যই দেওয়াল ভেঙে তাঁদের পথ মিলিয়ে দিচ্ছে।
হাজরা মোড়ে শুক্রবার মিনিডোর গাড়িতে দাঁড়িয়ে আইসিডিএস কর্মীদের সভায় সেলিম বলেছেন, ‘‘রাজ্যে জঙ্গলরাজ শেষ করতে হবে। গোটা রাজ্যে মানুষের জোট তৈরি হচ্ছে। সেটা বুঝতে পেরে তৃণমূল আরও ভয় পাচ্ছে।’’ তৃণমূল এবং বিজেপি-র বিরুদ্ধে যেখানে যে প্রার্থী শক্তিশালী, তাকেই ভোট দিতে বলেছেন সেলিম। আর এ দিনই কাছাকাছি সময়ে চেতলার অলি-গলিতে পায়ে হেঁটে মিছিল করেছেন প্রার্থী দীপা। কংগ্রেসের সঙ্গে সেই মিছিলে ছিল সিপিএমের পতাকাও। চেতলা ঘুরে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে চেতলা হাটে মিছিল শেষে দীপার আবেদন, ‘‘স্বৈরাচারী শাসক দলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আপনারা সবাই একজোট হোন।’’ আজ, শনিবার কালীঘাটে মমতার পাড়ায় আবার মিছিল করার কথা দীপার। তবে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনের রাস্তায় মিছিল নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি পুলিশ।
শুধু মুখ্যমন্ত্রীর খাস তালুকেই নয়, সবংয়ের ভেমুয়ায় বাম কর্মীদের নিয়ে যৌথ মিছিল করেছেন কংগ্রেস প্রার্থী মানসবাবু। তাঁর সঙ্গেই ছিলেন সিপিএমের জোনাল সম্পাদক চন্দন গুছাইত। মানসবাবু বলেন, ‘‘আগে সংঘর্ষ হলে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের ফোন করলে তাঁরা ফোন ধরতেন। সংঘর্ষ থেমে যেত। এখন ফোন করলে সংঘর্ষ বেড়ে যায়!’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘পরিবর্তনের পরিবর্তন হলে বাংলা বাঁচবে। মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।’’
এই আবহকেই আরও মসৃণ করতে চেয়ে বাগদা আসনটি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসকে ছেড়ে বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রে সরে গিয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক। কংগ্রেস সরে যাওয়ার ফলে বনগাঁ উত্তরে ফ ব-র প্রার্থী হচ্ছেন সুশান্ত বাওয়ালি। আর এক শরিক দল সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক প্রবোধ পণ্ডাও কলকাতা প্রেস ক্লাবে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘৯৫% আসনেই জোট হয়েছে। ৫% আসনে সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু তৃণমূলকে পরাজিত করতে গোটা বিষয়টা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে।’’
নিচু তলার চাপ যে উপর তলায় নেতৃত্বের মধ্যে টানাপড়েনকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে, তার উদাহরণ মিলছে আরও। বীরভূমের রামপুরহাট ও হাঁসন কেন্দ্রে এখনও বাম প্রার্থী আছেন। কিন্তু সেখানেই এ দিন কংগ্রেস প্রার্থীদের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছেন সিপিএমের নেতা-কর্মীদের একাংশ। উত্তরবঙ্গে হরিশ্চন্দ্রপুর বা মালতীপুরের মতো বামেদের জেতা আসন নিয়ে যাতে টানাপড়েন কেটে যায়, তার জন্য দলের মধ্যেই সক্রিয় হয়েছেন কংগ্রেস ও বাম কর্মীদের বড় অংশ। পরিস্থিতি আন্দাজ করে মালদহ জেলা কংগ্রেস নেত্রী মৌসম বেনজির নূর বলেছেন, ‘‘কোনও ভাবেই আমরা তৃণমূলকে জিতেত দেব না!’’