তাঁর কালো স্করপিও’র পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সরকারি বাসটা। গাড়ির পিছনের সিট থেকে নির্দেশ এসেছিল— ‘‘সাহস বেড়েছে দেখছি, ধর তো ওকে!’’
ধরা পড়েছিল বাস। চালকের কপালে জুটেছিল চপেটাঘাত। কালো স্করপিও ফের এগিয়ে গিয়েছিল বাসের আগে। পিছনে পড়েছিল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ডোমকল মোড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা দূর গ্রামের নিতান্তই আটপৌরে জনা কয়েক মানুষ।
ছবিটা মাস দেড়েক আগের। সদ্য দলের প্রার্থী তালিরা ঘোষণা করেছেন তৃণমূলনেত্রী। ডোমকলের প্রার্থী হয়েছেন সৌমিক হোসেন। তৃণমূলের এক জেলা নেতার বলছেন, ‘‘তালিকায় নামটা দেখেই রাতারাতি বদলে গিয়েছিল ছেলেটা।’’
পাশ কাটিয়ে যাওয়া বাস চালক একা নন, গত এক মাসে সৌমিকের এমন তরো ‘ঔদ্ধত্যের’ শিকারের তালিকাটা দীর্ঘ বলেই দাবি করেছেন স্থানীয় সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতারা। তাঁদের কথায়, ‘‘প্রার্থী হয়েই যদি এমন মেজাজ হয়, তাহলে কোনওক্রমে জিতে গেলে কী হবে বুঝতে পারছেন!’’
সৌমিক অবশ্য বলছেন, ‘‘এ সবই পিছিয়ে পড়ে এখন মুখ রক্ষার জন্য বিরোদীদের কুৎসা। সত্যিই কোনও অপকর্ম করে থাকলে তো পুলিশ রয়েছে। তারাই দেখবে।’’
বৈশাখের দুপুরে হুহু করে পারদ চড়ছে। প্রচারের পারদেও সেই মেজাজ ধরে রাখছেন সৌমিক। জনসভার পাশাপাশি হুড খোলা গাড়িতে চাপিয়ে তারকাদের পাশে নিয়ে ঘোরা, রোজ ছশমরা আড়ালে বিরোধীদের তুলোধোনা— খামতি নেই কিছুতেই।
তার মাঝেই হাঁফিয়ে গেলে হাত বাড়াচ্ছেন গাড়ির পিছনে। ইশারাই কাফি— এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে কচি ডাব কিংবা গ্লুকোজ গোলা জল। দু’হাত প্রসাতির করতেই দেহরক্ষী পরিয়ে দিচ্ছেন জহর কোট। দলের নেতারা বলছেন, এই আদবকায়দায় ‘জমিদারি’ ভাব না বদলালে ‘দুঃখ’ আছে।
সেই রাজকীয় মেজাজ থেকে অনেক দূরে রয়েছেন যিনি , তিনি বাম জামানার দীর্ঘ দিনের মন্ত্রী অনিসুর রহমান। বয়সের ভারে কাহিল হয়েও প্রচারে থেমে নেই। গ্রামের পর গ্রাম চষে ফেলছেন সকাল থেকে সন্ধে। কখনও সাইকেল, কখনও বা লছিমন, টোটো কিংবা নিতান্তই পায়ে হেটে। সময় পেলেই মুড়ির ঠোঙা নিয়ে বসে পড়ছেন সীমান্তের গ্রামীণ উঠোনে, বলছেন, ‘‘কী ই বারও ভোটটা দিবেন তো!’’ ঘোমটা প্রসারিত করে পাল্টা উত্তর আসছে ‘‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ!’’
এ দু’জনের মাঝেই বন্ধুত্বের গোলাপ কাঁটা নিয়ে নেমে পড়েছেন কংগ্রেসের আব্দুর রহমান। বলছেন, ‘‘আর যাকেই হোক বিজেপি, তৃণমূলে ভোটটা দেবেন না।’’ কংগ্রেসের দলীয় কর্মীরা আড়ালে বলছেন, ‘বন্ধুত্ব’ ছাড়া আর কীই বা বলা যায় একে।
ভোটের মাঠে আসলে লড়াইটা অবশ্য ইজ্জতের। সিপিএমের লড়াই মাটি ধরে রাখার। কংগ্রেসের লড়াই ‘বেইমান’কে (সৌমিক) শিক্ষা দেওয়ার। আর তৃণমূলের লড়াই অধীরের গড় থেকে নতুন করে ফুল ফোটানোর। ফলে রাজনৈতিক লড়াইয়ের বাইরেও কঠিন এক লড়াইয়ের সামনে দাড়িয়ে ডোমকল।
অন্যদিক কিছুটা দুবর্ল হলেও সিপিএমকে বন্ধুর আসনে পেয়ে কংগ্রেসও পেশি ফোলাচ্ছে। ফলে ডোমকলের গড়াইমারী, ঘোড়ামারা, জুড়ানপুর এই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বড় গণ্ডগোলের আশঙ্কা করছে প্রশাসন। রাজনৈতিক মহলের দাবি, ওই এলাকাগুলি বারুদ হয়ে আছে। যদি একবার কোনও একটি বুথে গণ্ডগোল শুরু হয় তা হলে তা দাবানলের মতই ছড়িয়ে পড়বে। তা ছাড়া মাস তিনেক থেকে ওই এলাকায় প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র মজুত হয়েছে বলেও পুলিশের কাছে খবর।
সীমান্তের ঘোড়ামারা গ্রাম পঞ্চায়েতের ঘোড়ামারা, মোমিনপুর ও কামুড়দেয়াড় গ্রামের ভোট কেন্দ্রে গণ্ডগোলের সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে গড়াইমারীর কুচিয়ামাড়ো, শাহাদিয়াড়, আমিনাবাদ এলাকাও উত্তেজনায় ফুটছে। তাছাড়া রায়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কুপিলা, শীতল নগর, শ্রীরামপুর এলাকাতেও গণ্ডগোলের আশাঙ্কা করছে প্রশাসন।
সীমান্ত উজিয়ে গ্রামগুলিতে ঢুকে পড়েছেন পড়শি দেশের ‘জামাই’রাও। ভোটটা প্রতি বার তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। কংগ্রেসর এক নেতা বলছেন, ‘‘ওই এলাকায় জামাইদের নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতায় যারা থাকে তারাই। এ বার সেই বার নিয়েছে তৃণূল।’’ যা শুনে তৃণমূল অবশ্য হাসছে। স্থানীয় নেতারা বলছেন, ‘‘আমাদের জামাইদের সঙ্গে ওঠাবসা নেই। ও সব কাজ বিরোধীদের।’’ তবে ঘরপোড়া গরুর মতোই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন ডোমকলের আম জনতা। কঠিন এই লড়াই এর মধ্যে দিয়ে কি আবার ডোমকল ফিরবে ডোমকলেই?