ভোটের কেশপুরে আঁধার রজনী

কেশপুরের মাঠে খেলা, অথচ তিনিই ক্রিজে নেই! এক সময় কঠিন উইকেটে রান তুলেছেন, বিপজ্জনক বোলিং সামলেছেন নিখুঁত ব্যাটিংয়ে। চার-ছক্কাও হাঁকিয়েছেন। আর সব থেকে বড় কথা কখনও আউট হননি, মানে জামানত জব্দ হয়নি।

Advertisement

বরুণ দে

কেশপুর শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৪৩
Share:

রজনী দোলই। নিজস্ব চিত্র।

কেশপুরের মাঠে খেলা, অথচ তিনিই ক্রিজে নেই! এক সময় কঠিন উইকেটে রান তুলেছেন, বিপজ্জনক বোলিং সামলেছেন নিখুঁত ব্যাটিংয়ে। চার-ছক্কাও হাঁকিয়েছেন। আর সব থেকে বড় কথা কখনও আউট হননি, মানে জামানত জব্দ হয়নি।

Advertisement

কেশপুরে ভোট মিটে গেল সোমবার। কিন্তু এ বার আর লড়াইয়ে ছিলেন না রজনীকান্ত দোলুই। ৯২-এও ভোট ময়দানে লড়ছেন খড়্গপুরের ‘চাচা’ জ্ঞানসিংহ সোহন পাল। কিন্তু ছিয়াত্তরে পা দিয়েই রজনীবাবু গুটিয়ে গেলেন। অথচ, এই সে দিনও ভোট এলে রজনীবাবুর ব্যস্ততা বেড়ে যেত। নাওয়া-খাওয়া ভুলে নেমে পড়তেন প্রচারে। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে ভোটভিক্ষা করতে। আবার কেশপুরের দোরগোড়ায় ভোট। কিন্তু রজনীবাবু এখন ব্যস্ত নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে। বলছেন, “অনেকগুলো ভোটে দাঁড়িয়েছি। কেশপুর আমার হাতের তালুর মতো চেনা। গতবারও তো লড়েছি। এ বার আর হল না।’’ তাতে যে ছিয়াত্তরে পা দেওয়া রজনীবাবুর একটা মনখারাপ আছে সেটাও স্পষ্ট। তাঁর কথায়, “ভোটের মাঠে থাকতে না পেরে খারাপই লাগছে!” একই সঙ্গে মানছেন, কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর।

রজনীবাবুর পড়াশোনা নাড়াজোল হাইস্কুলে। পরে মেদিনীপুর কলেজে। এক সময় যে স্কুলের ছাত্র ছিলেন, পরে সেই নাড়াজোল হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। কলেজে পড়াকালীনই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সেটা ১৯৫৬ সাল। ক্রমে রজনীবাবু হয়ে ওঠেন ভোট ময়দানের পাকা খেলোয়াড়। প্রথম ভোটে দাঁড়ানো ১৯৬৭ সালে। তখন বয়স মোটে সাতাশ। কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে সে বার কেশপুর থেকে জিতেও যান। ’৬৯-এ অবশ্য হারতে হয়েছিল। ফের জেতেন ’৭১ ও ’৭২-এর ভোটে। ’৭৭-এর ভোটেও বড় ব্যবধানে জেতেন। সে বার ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট। ১৯৮২-তে ফের হেরে যান রজনীবাবু। পুরনো কথা বলতে গিয়ে স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যান প্রবীণ মানুষটি। বলেন, “জ্যোতি বসু প্রচারে এসে বলেছিলেন, এখানে (কেশপুরে) রজনী দোলুইকে হারাতে হবে। সিপিএম সন্ত্রাস করে আমাকে হারিয়ে দিল।”

Advertisement

হেরেছেন। তবে ভোটে দাঁড়ানো ছাড়েননি রজনীবাবু। ’৬৭ থেকে ২০১১- এই সময়ের মধ্যে হাতে গোনা দু’-একটি বাদ দিলে প্রায় সব বিধানসভা ভোটেই কেশপুর থেকে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কখনও কংগ্রেসের হয়ে, কখনও তৃণমূলের হয়ে। ’৯৮ সালের পরে রাজনৈতিক সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে কেশপুর। সেই সময় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে নাম লেখান। ২০০১ সালে তৃণমূল রজনীবাবুকেই টিকিট দেয়। অবশ্য সিপিএমের নন্দরানি ডলের কাছে বেশ বড় ব্যবধানে হারতে হয় তাঁকে। পরে তৃণমূল ছেড়ে ফের কংগ্রেস ফিরে আসেন। ২০১১ সালের ভোটেও কংগ্রেসের হয়ে কেশপুর থেকে লড়েছেন তিনি।

রজনীবাবুর দেশের বাড়ি দাসপুরের নাড়াজোলে। এখন অবশ্য মেদিনীপুরের রবীন্দ্রনগরের বাড়িতে থাকেন। নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অধীনে রয়েছে বৃদ্ধাশ্রম থেকে পুনর্বাসন কেন্দ্র, অনেক কিছুই। কেশপুরে ভোটের দেওয়ালে এখনও রজনীর নাম লেখা রয়েছে। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য রং ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে! তবে কেশপুরের সঙ্গে সম্পর্কটা থেকেই গিয়েছে। মাস কয়েক আগে কেশপুর কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়েছেন রজনীবাবু। কেশপুরের লোকজন এখনও তাঁর কাছে আসেন। নিজেদের সমস্যার কথা জানান। সাধ্যমতো সাহায্যের চেষ্টাও করেন রজনীবাবু। তাঁর কথায়, “কেশপুরের সঙ্গে আমার নাড়ির টান। সন্ত্রাসের সময় কত মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিলেন। ঘরছাড়া মানুষদের মেদিনীপুরে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। তাঁদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। সেই সব দিনের কথা মনে পড়লে মন কেমন করে!”

ফের কি ‘কামব্যাক’ করতে পারেন? হাসছেন রজনীবাবু। বলছেন, “একটা আদর্শ-নীতিবোধ নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলাম। যখন দেখি নীতিবোধ হারিয়ে যাচ্ছে, তখন খারাপ লাগে।’’ একই সঙ্গে যোগ করছেন, ‘‘সব কিছু কি এ ভাবে আগে থেকে বলে দেওয়া যায়!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement