ভাতারের গ্রামে রাতভর বোমাবাজি, বাড়ি ভাঙচুর

বাবা সিপিএম, রেহাই নেই ছেলের

আলোচনাটা শুরু হয়েছিল ভোটের ফল নিয়ে। বুথ ফেরত সমীক্ষা ‘দিদি’র আসা নিশ্চিত করায় আগুনে ঘি পড়ে। আলোচনা গিয়ে ঠেকে বাড়ি ভাঙচুর, মারধর, বোমাবাজিতে। বাবা ‘সিপিএম’ করায় টানাহেঁচ়ড়া চলে দুই খুদের প্রাণ নিয়েও। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত তাণ্ডব চলে ভাতারের মোহনপুর গ্রামে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ভাতার শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০২:১৬
Share:

ভাঙচুরের পরে তছনছ ঘর-বাড়ি। পড়ে রয়েছে বুলেটের খোল (ইনসেটে)।

আলোচনাটা শুরু হয়েছিল ভোটের ফল নিয়ে। বুথ ফেরত সমীক্ষা ‘দিদি’র আসা নিশ্চিত করায় আগুনে ঘি পড়ে। আলোচনা গিয়ে ঠেকে বাড়ি ভাঙচুর, মারধর, বোমাবাজিতে। বাবা ‘সিপিএম’ করায় টানাহেঁচ়ড়া চলে দুই খুদের প্রাণ নিয়েও।

Advertisement

সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত তাণ্ডব চলে ভাতারের মোহনপুর গ্রামে। সিপিএম, তৃণমূল দু’পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে ভাঙচুর, মারধরের অভিযোগ দায়ের করেছে। পুলিশের হিসেবেই ১৭টি বাড়ি ভেঙেছে। টানা বোমাবাজি হয়েছে। বুলেটের খোলও পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। দু’পক্ষের সাত জনকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিও করানো হয়েছে। তবে বারবার শিশুরা কেন রাজনৈতিক হিংসায় জড়িয়ে যাবে, হামলায় তাঁরাই কেন নিশানা হবে— সে প্রশ্নও উঠছে।

পঞ্চম দফার ভোটের আগের দিন, উত্তর চব্বিশ পরগণার হালিশহরের টিটু সমাজপতির বাড়িতে হামলা হয়। অভিযোগ, বাম সমর্থক পরিবারের উপর আক্রমণের সময় রেহাই পায়নি তিন বছরের মেয়ে সায়ন্তিকা। শিশুটির হাত মুচড়ে দেওয়া হয়। বাঁশের বাড়িও মারা হয়। তার আগে ভাঙড়ের দুর্গাপুর পঞ্চায়েতের হরিহরপুর-পালপাড়ার পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া সাহিন মোল্লাকে ফেস্টুন ছেড়ার ‘অপরাধে’ মারধর করা হয়। এ দিন ভাতারেও সিপিএম কর্মী বাবাকে না পেয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় দুই ছেলেকে। বড় ছেলে হাত ছাড়িয়ে পালায়। ছোট ছেলেকে হামলাকারীদের থেকে কেড়ে নেন মা। সব ক’টা ঘটনাতেই অভিযোগ তৃণমলের বিরুদ্ধে।

Advertisement

সিপিএমের অভিযোগ, সোমবার সারা রাত বোমাবাজি, হুমকি চলার পরে ভোরে পরিবেশ একটু থমথমে ছিল। তবে সকাল ৬টাতেই ফের হামলা চালায় তৃণমূল। অভিযোগ, তৃণমূলের একদল দুষ্কৃতী পিস্তল, বোমা, রামদা নিয়ে মোহনপুর গ্রামের খাঁ পাড়ায় হামলা চালায়। সিপিএম কর্মী নবকুমার রায়ের বাড়িতেও ঢোকে তারা। নবকুমারবাবুকে না পেয়ে তাঁর বড় ছেলে কার্তিককে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। নবকুমারবাবুর স্ত্রী অর্চনাদেবী হামলাকারীদের হাতে-পায়ে পড়েন। তাঁর দাবি, সেই ফাঁকে বাড়ি থেকে ছুটে পালায় নবম শ্রেণির ছাত্র কার্তিক। কিন্তু বিপদ যায়নি। দাদা পালালেও নজরে পড়ে রায় ছোট ছেলে, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র দুধকুমার। তার হাত ধরে টানাটানি শুরু হয়। অর্চনাদেবীর দাবি, কোনও রকমে পালিয়ে বেঁচেছি। তবে গোলমাল থামলেও বাড়ি ফিরতে পারেনি কার্তিক। পরে সকাল ১০টা নাগাদ ছোট ছেলেকে পাশে নিয়ে অর্চনাদেবী বলেন, “তখনও ভাল করে ঘুম ভাঙেনি। চারিদিকে হইচই। বোমার আওয়াজ। পরিস্থিতি ভাল নয় বুঝেই আমার স্বামী ঘর ছাড়ে। তৃণমূলের লোকেরা পাড়ায় আসছে শুনে, আমিও ঘরে তালা দিচ্ছিলাম।” কিন্তু তার মধ্যেই হামলাকারীরা ঢুকে পড়ে বলে তাঁর দাবি। তাঁর অভিযোগ, ‘‘কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও ওরা আমার বড় ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। কোনও ভাবে হাত ছিটকে পালায় ও। তারপরে ছোট ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ওরা। কোনও রকমে বাঁচিয়েছি।’’

ঘটনার কয়েক ঘন্টা কেটে যাওয়ার পরেও আতঙ্ক কাটেনি দুধকুমারের। মাকে জড়িয়ে ধরে খালি বলছে, “মা, আমার খুব ভয় করছে। দাদা, কখন আসবে?” আবার কখনও বলছে, “ওরা আবার এসে আমাকে মারবে না তো?” অর্চনাদেবীও কেঁদেই চলেছেন। তাঁর কথায়, “কান্না ছাড়া আর কোনও জবাব আমার কাছে নেই।’’ বড় ছেলে আর স্বামী আরও অনেক সিপিএম কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে মাঠে আশ্রয় নিয়েছে বলেও তাঁর দাবি।

স্থানীয় সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদেরও অভিযোগ, “২৫-৩০ জন তৃণমূলের দুষ্কৃতী হামলা চালিয়েছে। পুলিশকে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। বরং পুলিশের সামনেই ওরা হামলা চালায়। বাড়িঘর ভাঙচুর, বোমাবাজি করে।” ধর্মপুকুর পাড় এলাকার কৃষ্ণা রায় ও পিরু রায়ের অভিযোগ, “আমাদের গলায় ধারালো অস্ত্র ধরে বাড়ির পুরুষরা দেখা না করলে পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে শাসিয়ে গিয়েছে।” সুদর্শন টক ও তাঁর ছেলে অরুণ টকেরও অভিযোগ, “গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমাদের পাড়ায় আসে। দোকানে লুঠপাট চালায়।”

সকালে মোহনপুর গ্রামের সামন্ত পাড়া ও খাঁ পাড়ায় গিয়েও দেখা যায়, একের পর এক বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। গোলার ধান মাটিতে পড়ে রয়েছে। দরজা-জানলাও ভাঙার চিহ্ন স্পষ্ট। একটি বাড়িতে জলের কলও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গ্রাম কার্যত পুরুষশূন্য। ভাতার থানার কয়েকজন পুলিশকে গ্রামের শিবতলায় দেখা গিয়েছে। সামন্তপাড়ার আন্না দিগ মাটির বারান্দার এক কোণে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেন, “এ ভাবে হামলা হলে আমরা খাব কী? বাঁচব কী ভাবে?”


সব হারিয়ে কান্না আন্না দিগের। নিজস্ব চিত্র।

সামন্তপাড়ায় আবার তৃণমূলের বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙার অভিযোগ উঠেছে সিপিএমের বিরুদ্ধে। তৃণমূল সমর্থক চিন্তামণি প্রামাণিক, রেখা দাসদের অভিযোগ, “সিপিএম দলবেঁধে এসে আমাদের বাড়ি ভাঙচুর করে, ঘরের ভিতর ঢুকে লুঠপাট চালায়। সেই ভয়ে আমাদের বাড়ির ছেলেরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে।” সিপিএম যে পাল্টা ভাঙচুর করেছে তা মেনে নিয়েছেন সামন্তপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা আরতি দিগ। বাড়িতে ভাঙচুর দেখানোর সময় তিনি বলেন, “আমাদের বাড়ির ছেলেরা গুন্ডামি করতে, মাতলামি করতে ওদের সঙ্গে দেয়নি বলে এই হামলা। একের পর এক বাড়ি ভাঙচুরের পরে আমাদের ছেলেরা রুখে না দাঁড়ালে আরও বড় ঘটনা ঘটে যেত।”

সিপিএমের ভাতার জোনাল কমিটির সম্পাদক সুভাষ মণ্ডলের অভিযোগ, “তৃণমূল যেখানেই মাথা তুলতে পারছে না, সেখানেই হামলা চালাচ্ছে।” সিপিএমের ভাতারের প্রার্থী বামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “তৃণমূল অমানবিক বলেই ছোট-বড় মানছে না, সে কারণে শিশু-নাবালকদেরও রাজনীতির শিকার করছে।” পাল্টা অভিযোগ তৃণমূলেরও। স্থানীয় বনপাশ অঞ্চলের আহ্বায়ক শেখ আহমেদ আলির পাল্টা, “সিপিএম প্রথমে হামলা চালায়। সে জন্য আমাদের ছেলেরা স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিরোধ করে।” জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ বলেন, “সিপিএম হেরে যাবে বলে আমাদের আক্রমণ করেছে।’’

পুলিশ জানিয়েছে, গ্রামে টহল চলছে। পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে। ঘটনাস্থল থেকে তৃণমূলের এক জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement