পাহারায়। ঝালদার খামার হাইস্কুলের বুথে। (নীচে), ভোট শেষে ফিরছেন কর্মীরা। পুরুলিয়ায়। সোমবার ছবি: সুজিত মাহাতো ও নিজস্ব চিত্র।
ভোটের আগের গোটা দিন-রাত কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল বুথ আর ভোট-কর্মীদের নিরাপত্তায়। অথচ, রাতের আঁধারেই প্রভাবিত করা যেতে পারে ভোটারদের। দেখানো হতে পারে ভয়, দেওয়া যেতে পারে মদ বা নগদ টাকার ঘুষ। এলাকায় এমন কাণ্ড ঘটলে নিজেদেরও অনেক ভোট বেহাত হয়ে যেতে পারে। সে আশঙ্কা থেকেই পুরুলিয়ায় রাত জাগলেন সিপিএম এবং কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। এমনকী প্রার্থীরাও।
কংগ্রেসের আশঙ্কা ছিল, তিন বারের বিধায়ক বাঘমুণ্ডির প্রার্থী নেপাল মাহাতোকে হারাতে তৃণমূল সব রকম চেষ্টা চালাবে। তাই কর্মীদের আটঘাট বেঁধে নিজেদের ভোট-ব্যাঙ্ক রক্ষার নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপালবাবু। সোমবার, ভোটের সকালে ঝালদার রাঁচি রোডে দলীয় কার্যালয়ে বসেছিলেন নেপাল মাহাতো। চোখ-মুখ বসা। বললেন, ‘‘ভোটের আগের রাতটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চিন্তে ঘুমনো যায় না।’’
নিশ্চিন্ত হতে কী করেছে কংগ্রেস? দল সূত্রের খবর, গভীর রাত পর্যন্ত ঝালদা ১ ব্লকের দঁড়দা, মশিড়া, পাটঝালদা, কাঁটাডিহি, পারডির মতো একাধিক গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছেন কংগ্রেস কর্মীরা। সঙ্গে নেপালবাবু। নেপালবাবুর অভিযোগ, রবিবার রাতে তাঁর কাছে খবর আসে, পারডি গ্রামে তাঁর নির্বাচনী এজেন্টকে তৃণমূলের ছেলেরা হুমকি দিয়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনকে ঘটনাটি জানান। যদিও তৃণমূল প্রার্থী সমীর মাহাতো দাবি করেছেন, ‘‘কাউকে প্রভাবিত করার দরকার পড়ে না। মানুষ আমাদের দিকেই রয়েছেন।’’
গত বার পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে জেতেন সিপিএমের সুশান্ত বেসরা। সুশান্তবাবু এ বারও প্রার্থী। রাত জেগেছেন তিনিও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জেলায় এসে বলেছেন, পুরুলিয়ার ন’টি কেন্দ্রের ন’টিই তাঁর চাই। একই বার্তা দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নেওয়া যাচ্ছিল না।’’
সিপিএম সূত্রের খবর, জামতোড়িয়া ও বুড়িবাঁধ পঞ্চায়েতের মতো যে সব দিক দিয়ে তৃণমূল কর্মীরা ঢুকে ‘বেচাল’ করতে পারেন বলে আঁচ করা হচ্ছিল, পাহারা দেওয়া হয়েছে সে সব এলাকাতেই। সাত-আটটি দলে ভাগ হয়ে বাম-কর্মীরা টহল দিয়েছেন এ মাথা থেকে ও মাথা। গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সুশান্তবাবু। সকালে ভোট শুরু হওয়ার আগে থেমেছে টহল। পাহারা দিতে হাজির থাকা সিপিএম কর্মীদের কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী যদি এ সব এলাকায় রাতে টহলে থাকত, তা হলে আমরা নিশ্চিন্ত হতাম। বাহিনী বুথের নিরাপত্তায় ব্যস্ত থাকায় পাহারাটা আমরাই দিয়েছি।’’
যে সব এলাকায় সিপিএমের পাহারা ছিল না, সে দিক থেকেই উঠেছে অভিযোগ। বান্দোয়ান কেন্দ্রের বরাবাজারের কয়েকটি পাড়ায় রবিবার রাতে তৃণমূলের লোকেরা ভোটারদের মধ্যে টাকা বিলি করছে বলে দাবি সিপিএমের। স্থানীয় বাসিন্দা তৃণমূলের জেলা পরিষদ সদস্যা সুমিতা সিংহ মল্ল অবশ্য অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছেন, ‘‘অপপ্রচার, অপপ্রচার।’’
জোট-সঙ্গী কংগ্রেসের কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা ভোট-চুরি ঠেকাতে কাজে লেগেছে বলে দাবি করেছেন রঘুনাথপুর এলাকার এক সিপিএম নেতা। তাঁর কথায়, ‘‘গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস, তৃণমূলের জোট ছিল। এ বার সেই কংগ্রেস কর্মীরাই আমাদের পাশে। ফলে তৃণমূল কোন-কোন পকেটে কী ভাবে গত বার ভোট কিনেছিল, সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ বার সেই সব এলাকায় আমাদের কর্মীদের আগাম সতর্ক করা হয়েছিল।’’ তাঁর দাবি, রবিবার রাতে পাড়ার দুবড়া, দেউলি, উদয়পুর প্রভৃতি গ্রামে তৃণমূলের লোকেরা ভোট কিনতে টাকা নিয়ে পৌঁছে গেলেও সিপিএম ও কংগ্রেস কর্মীদের পাহারা দিতে দেখে গা ঢাকা দেয়।
তৃণমূলের এক নেতাও অবশ্য এলাকা পাহারা দিতে রাত জেগেছেন। তিনি প্রার্থী নন, মানবাজারের প্রার্থী সন্ধ্যারানি টুডুর স্বামী গুরুপদ টুডু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সিপিএম আর কংগ্রেস কী কৌশল করে, কে জানে! ঝুঁকি নিতে চাইনি।’’ ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের জেলা কোর কমিটির সদস্য নব্যেন্দু মাহালি বলেছেন, ‘‘পাহারার নামে বিরোধীরা বেচাল করেছে কি না, সেটাই দেখা দরকার।’’