বাঁ দিকে, দুর্নীতি অস্ত্রে শাসক-বধের চেষ্টা সিপিএমের। ডান দিকে, তৃণমূলের প্রচার। ছবি: মধুমিতা মজুমদার।
কোথাও সিপিএম-কংগ্রেস জোটকে কটাক্ষ। কোথাও বা আবার সারদা-নারদ কটাক্ষ! — কালনায় ভোটের উত্তাপ বাড়তেই ছড়ার ছন্দে দেওয়াল মাতাতে চেষ্টার কসুর করছে না কোনও দলই।
শাসককে খোঁচা দিতে বিরোধীদের ছড়ার বিষয় মূলত দুর্নীতি। যেমন, কালনা শহরের এক গলিতে লেখা, ‘‘দিদির ভাই/টেট সারদা নারদা/ সবেতেই ঘুষ খাই/ আর কোন কাজ নাই।’’ প্রসঙ্গত রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শাসকদলের নেতাদের নাম জড়িয়েছিল টেট কেলেঙ্কারিতে। জবানিপাড়ায় আবার জোটের ছবি সিপিএমের প্রচারে। ছড়া কেটেছেন বাম কর্মীরা— ‘‘জোট বাঁধছে জনতা/ প্রমাদ গুনছে মমতা।’’ রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে বছরভর সরব হতে দেখা গিয়েছে বিরোধীদলগুলিকে। রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে বাম টিপ্পনি— ‘‘গত পাঁচ বছরে দুটি শিল্প/ চপ শিল্প/ ঢপ শিল্প।’’ শুধু ছড়াতেই থেমে থাকেননি বাম কর্মীরা। শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে শাসককে বিঁধতে বামেদের ভরসা ব্যঙ্গচিত্রও।
ছড়ার যুদ্ধে পাল্টা দিতে নারাজ তৃণমূলও। ভোট ময়দানে বাম-কংগ্রেসের জোটের আদর্শগত ভিত্তি নিয়ে একাধিকবার কটাক্ষ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দেওয়াল লিখনেও কার্যত সেই রেশ ধরে রাখতে চেয়েছেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। যেমন, ‘‘ভোটে নতুন চমক/ সাপে নেউলের সন্ধি/ বাম কংগ্রেস জোট বেঁধেছে/ মাথায় নতুন ফন্দি।’’ রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে কটাক্ষের জবাব দিতে তৃণমূলের ছড়া হাতিয়ার উন্নয়নের লম্বা তালিকা। শহরেরই একটি দেওয়ালে লেখা, ‘‘সেতু, বিদ্যুৎ, রাস্তা/ অর্জিত আজ আস্থা/ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য/ করছে যথাসাধ্য/ ভরসা জাগায় মমতা/ বলছে বঙ্গ জনতা।’’ জনপ্রিয় অ্যানিমেশন চরিত্র ছোটা ভীমকেও তৃণমূল সরকারের প্রচারের মুখ করে ফেলতে চেয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
শহরের পাশাপাশি বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন গ্রামেও চলছে জোর ছড়া-তরজা। বিশ্বজিৎবাবুর নির্বাচনী এজেন্ট কালনা ২ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি প্রণব রায়। প্রণববাবু নিজে দীর্ঘদিন ধরেই লেখালেখি করেন। একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন দীর্ঘদিন ধরে। ভোট মরসুমে তিনি বসে থাকতে পারেননি। তাঁর লেখা ছড়া ইতিমধ্যেই দলের নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। তা দিয়ে চলছে দেওয়াল ভরানোর কাজ। ‘‘আতা গাছে তোতা পাখি ডালিম গাছে মৌ/ কংগ্রেস পাটি বর সেজেছে, সিপিএম তার বউ’’— এই ছড়াটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে বলে দাবি করেন এক তৃণমূল কর্মী।
এমন ছড়া-প্রচারের পরিকল্পনা নেওয়া কেন? তৃণমূল ও সিপিএম নেতৃত্ব, উভয়েরই দাবি— সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রচারে অভিনবত্ব আনতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া। সিপিএমের কালনা জোনাল কমিটির সদস্য স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘ভিন্ন আঙ্গিকের দেওয়াল লিখন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আলাদা আগ্রহ রয়েছে।’’
ভোট মরসুমে ছড়া-কাটা অবশ্য বাংলার সংস্কৃতিতে নতুন কিছু নয়। এক প্রবীণ ভোটারের মনে পড়ে ১৯৬৯ সালের নির্বাচনে শহরের দেওয়াল-ছড়ার ছবিটা। কী রকম ছিল সেই ছড়ার যুদ্ধ? কংগ্রেস লিখেছিল— ‘‘যুক্তফ্রন্টে কী পেলাম/ গুলি-বুলি-লাল সেলাম।’’ যুক্তফ্রন্টের পাল্টা ছিল, ‘‘শুন হে দেশের ভাই/ যুক্তফ্রন্টে গদিই সত্য/ দেশপ্রেম কিছু নাই।’’ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও ছড়া কাটতে দেখা গিয়েছে বারবার। সেই তালিকায় ত্রিপুরার বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার সদস্য প্রয়াত অনিল সরকার, বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ীরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কালনাতেও এক তৃণমূল নেতা ভোট-ছড়ার বই লিখে ফেলেছেন।
তবে ছড়া-যুদ্ধ চললেও তা যেন শালীনতার মাত্রা না ছাড়ায় সে বিষয়ে সচেতন সব পক্ষই। প্রণববাবু বলেন, ‘‘দলের কর্মীদের জানানো হয়েছে, দেওয়ালে কোনও ব্যক্তি কুৎসা করা যাবে না।’’ শাসক-বিরোধীর ছড়ার-যুদ্ধ দেখে খুশি কালনার ভোটারেরাও। সকালে বাজার করতে বেরিয়ে দেবব্রত মণ্ডল নামে এক কালনার শিক্ষক দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘গালমন্দের বাজারে রাজনীতির ভাষা ছড়ায়-ছন্দে হলে তো মন্দ নয়!’’