দুই মেজাজে। নিজের বাড়িতে শান্তিরাম মাহাতো।
কব্জিতে মোটা লাল সুতো। পরনে ধোপদুরস্ত সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। ঝাড়খণ্ডের রাজরাপ্পা ছিন্নমন্তা মন্দির থেকে পুজো দিয়ে ফিরলেন তিনি।
আর প্রতিপক্ষ? এক মনে অমিতাভ আর রাজেশ খন্নার একের পর এর সিনেমা দেখছেন! হালে বদলে ফেলেছেন কেবল কানেকশনও। আরও বেশি সিনেমা চাই যে।
প্রথম জন বলরামপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী। মন্ত্রীসভার বিদায়ী সদস্যও বটে, শান্তিরাম মাহাতো। অন্য জন, শান্তিরামবাবুরই এক সময়ের সহযোদ্ধা। বলরামপুরের কংগ্রেস প্রার্থী জগদীশ মাহাতো।
এমন হাজারো বিষয় আছে, যাতে ওঁদের মতের মিল নেই। কিন্তু, এখন একটা বিষয়ে উভয়েই একমত। ফলের অপেক্ষায় আর ‘তর সইছে না’ দু’জনেরই! হবে নাই বা কেন? পরীক্ষা হয়েছে দেড় মাস আগে। এখন ফলের জন্যে আকুল হওয়া কি অস্বাভাবিক!
চিন্তা হচ্ছে?
এই প্রশ্নটারই যেন অপেক্ষায় ছিলেন শান্তিরামবাবু। সেই ১৯৭৯ সাল থেকে নির্বাচনে লড়ছেন। এ বারের ভোট বাদ দিয়েও আট বার বিধানসভা এবং দু’বার লোকসভায় লড়েছেন। ভোটের ময়দানের অলিগলি হাতের তালুর মতই চেনা। এ হেন দুঁদে রাজনীতিক বলছেন, ‘‘সত্যিই, ধৈর্যের এমন পরীক্ষা আগে কখনও দিইনি। সেই ৪ এপ্রিল ভোট হয়েছে। ১৯ মে রেজাল্ট। এত দিন অপেক্ষা কি সহজ কথা!’’
অনুগামীরা যোগ করছেন, ‘‘বলরামপুর কেন্দ্রের দিকে জেলা তো বটেই, গোটা রাজ্যের নজর রয়েছে। দাদার চিন্তা হবে না!’’ ভোটের একেবারে মুখে বাম-কংগ্রেসের নির্বাচনী সমঝোতা মাথাব্যাথা কিছুটা হলেও যে বাড়িয়ে দিয়েছে, একান্তে তা-ও মেনে নিচ্ছেন তাঁরা। মুখে তেমনটা মানতে না চাইলেও শরীরের হালচাল বুঝিয়ে দিচ্ছে গতিক বিশেষ ভাল নয়!
চেম্বারে রোগী দেখার ফাঁকে জগদীশ মাহাতোর চোখ কাগজে।
সুগারের সমস্যা রয়েছে শান্তিরামবাবুর। চিকিৎসকেরা চিন্তা করতে পই পই করে নিষেধ করেছেন। কিন্তু, মন কি মানে? সহধর্মিনী ছায়ারানীদেবী জানাচ্ছেন, টিভি দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে যাচ্ছেন। গরম চা এক সময় জুড়িয়ে যাচ্ছে! ভাই বিমলকান্ত মাহাতোর কথায়, ‘‘শান্তিদার চা টা চাই-ই। তবে, এখন একটু বেশিই খাচ্ছেন।’’
চাপ কাটাতেই রাজরাপ্পার জাগ্রত মন্দিরে যাওয়া। গোপন করলেন না সর্বক্ষণের এক সহচর। যোগ করলেন, ‘’১৯ মের আগে একবার চিড়কা মন্দিরে যেতে চাইছেন দাদা।’’ এত কথার পরেও মচকাচ্ছেন না বর্ষীয়ান নেতা। একগাল হেসে শান্তিরামবাবু বলছেন, ‘‘ভালটাও তো দেখতে হবে। এই অবসরে পরিবারকে সময় দিতে পারছি। সেটা কম নাকি?’’
দুঃশ্চিন্তায় প্রতিপক্ষ কম কোথায়?
এক সময়ের সহযোদ্ধা কংগ্রেস প্রার্থী জগদীশ মাহাতো ২০০৯ এর লোকসভা ভোটে শান্তিরামবাবুরই সহযোদ্ধা ছিলেন। এখন দু’জনার দুটি পথ গিয়েছে দু’দিকে। সে বার জগদীশবাবুর চিন্তা ছিল শান্তিরামবাবুকে জেতানো। স্বাভাবিক ভাবেই এ বার ঠিক উল্টো!
পেশায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। বলরামপুরের কালীতলায় চেম্বার। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে নামশোল গ্রামের বাড়ি থেকে সোজা চেম্বারে। রোগী দেখে ফিরে দুপুরে ভাতঘুম। নাম ঘোষণা ইস্তক সে রুটিন বদলে গিয়েছে। দিনের একটা বড় সময় কেটে যায় ফলাফল নিয়ে বহুস্তরীয় আলোচনায়। কখনও চেম্বারে, আবার কখনও পার্টি অফিসে। জমতে থাকে ফাঁকা চায়ের কাপ। বিস্তর পাটিগণিত, রসায়নের চর্চা শেষে যখন ঘড়ির দিকে তাকানোর অবসর পান, ততক্ষণে গড়িয়ে গিয়েছে বহু সময়। মাথায় ওঠে ভাতঘুম। শুধু কি ভাতঘুম। জগদীশবাবু নিজেই বলছেন, ‘‘রাতেও ঘুম হচ্ছে কই! শুয়ে থাকি ঘুম আসতে চায় না!’’ আরও বলছেন, ‘‘অষ্টপ্রহর কেবল ফল নিয়ে আলোচনা। সে বাড়ি হোক বা বাজার, রাস্তা হোক আর চেম্বার!’’
স্বাদবদল করতে সিনেমা দেখতে শুরু করেছেন তিনি। বলছেন, ‘‘সিনেমা দেখে টেনশন কাটাচ্ছি। আমি অমিতাভ ও রাজেশ খন্নার ফ্যান। আজও ভাল লাগে। পুরনো ছবিগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি।’’
আর সময় পেলে? একান্তে মানছেন— ‘‘ক্যালেন্ডারে চোখ রাখছি। কবে আসবে ১৯ তারিখ!’’
ছবি: সুজিত মাহাতো