সারথির বিদায়, রথের চাকাও বসে আলিমুদ্দিনে

রথ আছে। কিন্তু ময়দানে দেখা যাচ্ছে না সেনাপতি আর তাঁর পুরনো সারথিকে!যুদ্ধ এ বার সেয়ানে-সেয়ানে। ভোটের বেলা বয়ে যাচ্ছে! তবু তাঁরা দু’জন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বাইরে এ বার আর কোথাও নেই!

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৪৩
Share:

পুরনো বাহনে পুরনো সারথি মহম্মদ ওসমান। — ফাইল চিত্র

রথ আছে। কিন্তু ময়দানে দেখা যাচ্ছে না সেনাপতি আর তাঁর পুরনো সারথিকে!

Advertisement

যুদ্ধ এ বার সেয়ানে-সেয়ানে। ভোটের বেলা বয়ে যাচ্ছে! তবু তাঁরা দু’জন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বাইরে এ বার আর কোথাও নেই!

সেনাপতি আপাতত আলিমুদ্দিনে স্বেচ্ছাবন্দি! একের পর এক জেলা থেকে ডাক আসছে। কিন্তু তিনি ডাক ফিরিয়ে চলেছেন! সে খবর শুনে উতলা হচ্ছেন অন্য জন। সেই ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হয়েছিল একটা সফর। সাড়ে তিন দশকে ৬-৬টা বিধানসভা নির্বাচনে জেলায় জেলায় একই সওয়ারি নিয়ে দৌড়েছিলেন পুরনো সারথি। এ বারই প্রথম সেই দৌড় বন্ধ!

Advertisement

যে যতই ডাকুক, ভোটের প্রচারে বাইরে বেরোতে এখনও নারাজ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া করে তৃণমূলকে রুখতে আসরে নামার পরে বাম শিবিরে এখনও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর চাহিদা প্রচুর। শারীরিক কারণে তিনি উত্তরবঙ্গে যেতে পারবেন না, দলের সকলে জানে। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের গুচ্ছ গুচ্ছ জেলা থেকে অনুরোধ আসছে, পারলে ১০ মিনিটের জন্যও হাজির হয়ে কয়েকটা কথা বলে যান। কিন্তু যাঁর জন্য আবেদন, তিনি এখনও সম্মতি দিচ্ছেন না!

ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে বুদ্ধবাবু দু’বেলা আসেন আলিমুদ্দিনে। দলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে তাঁর মস্তিষ্ক এখনও প্রবল সক্রিয়। প্রথম পর্বের ভোটের দিন কোথায় কোন বুথে কত শতাংশ ভোট পড়ল, কে কোথায় এজেন্টকে বাধা দিল— এই পরিসংখ্যান জর্জরিত প্রতিক্রিয়া এ বার দেয়নি আলিমুদ্দিন। বরং প্রতিক্রিয়া হয়েছে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। যাতে তৃণমূলকে পাল্টা চাপে রাখা যায়। এই পরিবর্তনের পিছনে মাথা বুদ্ধবাবুরই। কিন্তু প্রকাশ্য জনদরবারে হাজির হতে এখনও তাঁর অনীহা। সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, ‘‘বুদ্ধদা দলের মধ্যে অত্যন্ত সক্রিয়। জেলার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। কোন কোন বিষয়ের উপরে আমাদের বলতে হবে, পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু বাইরে প্রচারে বেরোনোর কোনও কর্মসূচি এখনও নেই।’’ ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যারাকপুরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সমাবেশেই তাঁর শেষ প্রকাশ্য আবির্ভাব ছিল! দলের অন্দরে বুদ্ধবাবু জানিয়ে রেখেছেন, এ বার তিনি কোথাও যেতে চান না। আর কলকাতা বা কাছেপিঠের দু-একটা সমাবেশে গেলে বাকিদের মনে হতে পারে, তারা কী অন্যায় করল? এই অবিচার তিনি হতে দিতে চান না!

আর ঠিক এখানেই মহম্মদ ওসমান ভাবছেন, এটা আসলে অবিচারই হচ্ছে! কাশীপুর থেকে ১৯৮২ সালে বিধানসভা ভোটে বুদ্ধবাবু হেরে যাওয়ার পরে পার্টির গাড়ি চালাতে শুরু করেছিলেন ওসমান। পরের ভোটে জিতে বুদ্ধবাবু আবার মন্ত্রী হওয়ার সময় থেকে ওসমানও সরকারি ভাবে দায়িত্বে। সম্প্রতি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিতে হয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের পরেও তাঁর ভাবনায় এখনও বুদ্ধবাবু! ওসমানের কথায়, ‘‘এই রকম একটা ভোট হচ্ছে। এত জোর লড়াই। সেখানে উনি (বুদ্ধবাবু) এক বার গিয়ে কোথাও দাঁড়াবেন না? লোকে তো ওঁর কথা শুনতে চায়!’’

ওসমানের স্মৃতিতে আছে ২০০১ সালের সেই ‘এ বার না হলে নেভার’ খ্যাত ভোটের আগে গাড়ি চালাতে চালাতে তিনিই তৎকালীন উপ-মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছিলেন, জ্যোতি বসুর শরীর ঠিক নেই। প্রচারের মূল দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে। প্রথমে গররাজি, বুদ্ধবাবু জানতে চেয়েছিলেন সেটা কি সম্ভব? তার পরে জেলায় জেলায় ওসমানের গাড়িতেই ভোট-সফরে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এবং ভোটের পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে!

আলিমুদ্দিনে এসেই এখন দু’বেলা সময় কাটিয়ে যান ওসমান। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় ও বিশ্বস্ত চালকের চাকরির মেয়াদ একটু বাড়ানো হোক, এই মর্মে আবেদন গিয়েছিল পরিবহণ দফতরের কাছে। কাজ হয়নি। শেষে বিরোধী দলনেতা হিসেবে সূর্যকান্ত মিশ্র ওসমানের জন্য সরকারের কাছে ফের অনুরোধ পাঠিয়েছেন। তার পরে ভোটের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত না হওয়ায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবুই আপাতত ওসমানকে বলেছেন আলিমুদ্দিনে আসতে। প্রয়োজনে না হয় তিনি পার্টির গাড়িই ফের চালাবেন।

যেতে চেয়েও ভোটে যেতে পারছেন না ওসমান। কারণ, নিরাপত্তার খাতিরে বুদ্ধবাবু সরকারি গাড়ি চাপেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত ওসমানের সেই গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার উপায় নেই। আবার তিনি যদি পার্টির গাড়ি চালাতে যান, বুদ্ধবাবু সেই গাড়িতে সওয়ার হবেন, তা-ও নয়। তবে গাড়ির প্রশ্ন তো পরে। বুদ্ধবাবু এ বার যেতেই চাইছেন না! সিপিএম সূত্রের খবর, কলকাতা বা সংলগ্ন এলাকায় হাতে-গোনা দু-একটা কর্মসূচিতে তাঁকে হাজির করানোর মরিয়া চেষ্টা চলছে। সোমেন মিত্র বা দীপা দাশমুন্সির মতো জোটের প্রার্থীদের সমর্থনে সামান্য রোড-শো’য় নিয়ে যাওয়ার ভাবনা রয়েছে। কিন্তু শেষমেশ রাজি করাবেন কে?

পনেরো বছর আগে রাজি করানোর বান্দা তো আলিমুদ্দিনেই বসে! রথের রশি শুধু হাতে নেই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement