ফাইল চিত্র
নীলবাড়ির দখল পেলে বাংলার সব মানুষকে বিনামূল্যে করোনার টিকা দেবে বিজেপি সরকার। বিহার মডেলে পশ্চিমবঙ্গেও বিধানসভা নির্বাচনের ইস্তেহারে এমন প্রতিশ্রুতিই দিতে চলেছে রাজ্য বিজেপি। প্রসঙ্গত। ২০২০ সালে বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ইস্তেহারেও এমনই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে তখনও করোনার টিকা বাজারে আসেনি। টিকা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলার মধ্যেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ তখনও পর্যন্ত ‘অদৃশ্য’ টিকা বিনামূল্যে বিহারবাসীকে দেওয়ার কথা ভোটের ইস্তেহার প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন।
বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের ইস্তেহার তৈরির লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই দফায় দফায় বৈঠক চালাচ্ছে গেরুয়া শিবির। তাতে রাজ্যের উন্নয়নে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। বিজেপি সূত্রে খবর, তার মধ্যে থাকতে চলেছে বিনামূল্য টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও। রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের কথায়, “দেশের সব মানুষকেই বিনামূল্য টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এই রাজ্যেও সেই কাজ শুরু হয়েছে। ক্ষমতায় আসার পরে আমরা সেটাই এগিয়ে নিয়ে যাব। ইস্তেহারে থাকুক বা না থাকুক, রাজ্যের সব মানুষের টিকার ব্যবস্থা করবে বিজেপি সরকার।” অন্য দিকে, রাজ্য বিজেপি-র ইস্তেহার তৈরির দায়িত্বে থাকা কমিটির অন্যতম সদস্য বাঁকুড়ার সাংসদ সুভাষ সরকারের বক্তব্য, “শুধু টিকাকরণ নয়, বাংলার সার্বিক উন্নয়নের কথাই থাকবে ইস্তেহারে। কোনও বিষয়ই বাদ যাবে না। শিল্প, শিক্ষা, পর্যটন, আইনশৃঙ্খলা— সব ক্ষেত্রেই বাংলায় আমূল বদল দরকার। সেই কাজটাই করবে আমাদের সরকার।”
ক্ষমতায় এলে কী কী করবে বিজেপি? নিয়ম অনুযায়ী তা নির্বাচনের ইস্তেহার প্রকাশ করেই ঘোষণা করার কথা। এই বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে দেখা বিজেপি সেই কাজ শুরু করে দিয়েছে আগে থেকেই। সে কারণে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে বিজেপি। প্রাক্তন সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্তকে মাথায় রেখে একটি ‘বিদ্বজ্জন সেল’ তৈরি করা হয়। কমিটিতে রাখা হয় সর্বভারতীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) শিব প্রকাশ, রাজ্য দলের সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তী, রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অধিকর্তা অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়-সহ অনেকে।
‘লক্ষ্য সোনার বাংলা’ কর্মসূচিতে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় বিদ্বজ্জনদের নিয়ে বৈঠক করেন কমিটির সদস্যরা। তাতে অংশ নেন ভিন্ রাজ্য থেকে আসা কেন্দ্রীয় স্তরের নেতারাও। সেখান থেকে বোঝার চেষ্টা হয় মানুষের চাহিদা। এর পরে অমিত শাহর সাম্প্রতিক রাজ্য সফরেও ইস্তেহার প্রসঙ্গে রাজ্য নেতারা কথা বলেন। অনির্বাণের বক্তব্য, “আমাদের ইস্তেহারে শুধু স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা থাকবে না। শুধু এখানে উড়ালপুল, ওখানে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কথা থাকবে না। ২০৪৭ সালে আমাদের স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্ণ হবে। তার জন্য হাতে রয়েছে ২৫ বছর সময়। এই ২৫ বছরে বাংলাকে কী ভাবে ‘সোনার বাংলা’ বানানো যায়, তার সার্বিক পরিকল্পনার ছবি দেখা যাবে ইস্তেহারে।”
তবে ইস্তেহারে যা-ই থাকুক, বিজেপি চাইছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিংবা অমিতের মুখ থেকেই সেই বার্তা দেওয়া হোক ভোটারদের। রাজ্যে এখনও পর্যন্ত বিজেপি কোনও ‘মুখ’-কে সামনে রেখে লড়ছে না। মোদী-শাহই ‘মুখ’। তাই তাঁদের ঘোষণা আমজনাতর কাছে বেশি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হবে বলে মনে করছে বিজেপি। সেই কাজ শুরুও করে দিয়েছেন বিজেপি-র দুই সেনাপতি। একদিকে মোদী ঘোষণা করেছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে রাজ্যে ‘কিষাণ সম্মান নিধি’ প্রকল্প চালু ও বাংলার কৃষকদের ‘না-পাওয়া’ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই। অন্য দিকে, অমিত ঘোষণা করেছেন, প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মান’ প্রকল্প বাংলায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বস্তুত, গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানার জনসভায় অমিত একাধিক বড় ঘোষণা করেছেন। যা কার্যত বিজেপি-র ইস্তেহারেরই অঙ্গ। তিনি জানিয়েছেন, বিজেপি বাংলার ক্ষমতায় এলে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য সপ্তম বেতন কমিশন চালু করা হবে। রাজ্যের মৎস্যজীবীদের জন্য বছরে ৬ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। আমপানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলায় দাঁড়িয়ে অমিত দাবি করেছেন, ‘‘ত্রাণ বিলিতে দুর্নীতি করেছে রাজ্য সরকার ও তৃণমূল। বিজেপি ক্ষমতায় এলে সেই দুর্নীতির তদন্তে কমিটি গঠন করা হবে।’’ সরকারি চাকরিতে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতিও দেন অমিত। জানান, বিজেপি ক্ষমতায় এলে ‘মৎস্যজীবী প্রডিউস অর্গানাইজেশন’ তৈরি করবে। যাতে ওই জীবিকার মানুষেরা মাছের ন্যায্য দাম পান। সেই লক্ষ্যে রাজ্যে আলাদা দফতরও গঠন করা হবে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় ‘সি ফুড প্রসেসিং হাব’ গঠনের পাশাপাশি গঙ্গাসাগরকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং বিদেশি পর্যটক টানতে গঙ্গাসাগর মেলাকে ‘আন্তর্জাতিক মেলা’-র স্বীকৃতি দেওয়া হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন অমিত।
তবে এর আগের সফরেও বেশ কয়েকটি প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে গিয়েছেন অমিত। কোচবিহারে গিয়ে রাজবংশী মন পেতে তিনি বলেছেন, কেন্দ্র শীঘ্রই ভারতীয় সেনায় ‘নারায়ণী ব্যাটালিয়ন’ তৈরি করবে। সেই সঙ্গে অমিত বলেছেন, মদনমোহন মন্দির ও কামতেশ্বরী মন্দির এবং পঞ্চানন বর্মার জন্মস্থল ঘিরে একটা ‘টুরিস্ট সার্কিট’ গড়ে তোলা হবে। প্রতিশ্রুতি শোনা গিয়েছে ঠাকুরনগরের সভাতেও। সে দিন নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন কিছু না বললেও অমিত জানিয়েছেন, ‘ঠাকুরনগর’ স্টেশনের নাম ‘শ্রীধাম ঠাকুরনগর’ করা হবে। মতুয়া দলপতিদের জন্য পেনশন, শরণার্থী কল্যাণে আলাদা প্রকল্পের কথাও বলেছেন তিনি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মতুয়া সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের জন্য কিছু প্রকল্প চালু করা নিয়েও কেন্দ্র ভাবনাচিন্তা করবে।
এরই মধ্যে সোমবার রাজ্যে আসছেন মোদী। নোয়াপাড়া থেকে দক্ষিণেশ্বর মেট্রোরেলের যাত্রার সূচনার পর হুগলির সাহাগঞ্জে রাজনৈতিক সমাবেশ করবেন তিনি। রাজ্য বিজেপি আশা করছে, সেদিনও নতুন কিছু ঘোষণা করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। তেমন কিছু হলে তা-ও হবে বিজেপি-র ইস্তেহারের অঙ্গ।