প্রার্থী ঘোষণা থেকেই রাজ্য সিপিএম নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা এ বার যুব সম্প্রদায়কে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন। দলের যুব নেতা-নেত্রীদের প্রার্থী করার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচন পরিচালনার প্রধান দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে যুব সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের। মেঘের আড়ালে থেকে দলের হয়ে লড়াইয়ে বড় ভূমিকা থাকছে আসলে এঁদেরই।
প্রার্থী কোন দিন কখন কোন এলাকায় যাবেন, এলাকা বিশেষে তাঁর বক্তব্য কী হবে, সঙ্গে কারা থাকবে, কোথায় সভা-মিছিল হবে— কারা বক্তব্য রাখবে এ সবই ঠিক করছেন মেঘের আড়ালের এই ‘ইন্দ্রজিৎ’রা। এ ছাড়াও, প্রশাসনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ রক্ষা করার দায়িত্বও
তাঁদের উপরেই। নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সিপিএম তুলে আনতে চাইছে
ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে।
বামপন্থী দলে বরাবরই ভোটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে সংগঠনের। প্রার্থীকে নির্ভর করতে হয় সংগঠনের উপরে। সেই সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব যাঁর উপরে থাকে, তাঁরই দায় থাকে সব চেয়ে বেশি। ফলের নিরিখে প্রশংসা বা সমালোচনা জোটে সেই নেতার, যিনি দলের তরফে ওই কেন্দ্রের আহ্বায়ক বা নির্বাচনী এজেন্ট হন। এই ধরনের গুরু-দায়িত্বে
সচরাচর রাখা হয় দলীয় সংগঠনের পোড় খাওয়া নেতাকে। ভোটের ময়দানে ছাত্র, যুব, মহিলা-সহ দলের সমস্ত গণসংগঠনকেও নামানো
হয়। কিন্তু দলীয় প্রার্থীকে নির্বাচনী বৈতরণী পার করানোর গুরু দায়িত্ব এর আগে এ ভাবে এক ঝাঁক যুব নেতার কাঁধে তুলে দিতে দেখা
যায়নি সিপিএমে।
যেমন, সায়নদীপ মিত্র। সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি। কলকাতা-লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা কেন্দ্রের দায়িত্ব এ বার সায়নদীপের উপরে দিয়েছে দল। বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবেই কামারহাটির পরিচিতি ছিল এক কালে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এই কেন্দ্র থেকে সিপিএমের শ্রমিক নেতা শান্তি ঘটক দীর্ঘ দিন নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাম সরকারে শ্রমমন্ত্রী ছিলেন শান্তিবাবু। তাঁর মৃত্যুর পরে ওই কেন্দ্র থেকে পরপর দু’বার জিতেছিলেন সিপিএমের জেলা নেতা মানস মুখোপাধ্যায়।। পরিবর্তনের ভোটে ২০১১ সালে মানসবাবুকে হারিয়ে তৃণমূলের মদন মিত্র ওই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ বারেও ওই দুই প্রার্থীর মধ্যেই লড়াই। সারদা-কাণ্ডে জড়িয়ে মদনবাবু এখন জেলে। তাঁর অনুগামীরা ‘দাদা’কে জেতানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। আর সিপিএম এক কালের ‘দুর্গ’ কামারহাটি পুনরুদ্ধার করতে কোমর বেঁধে নেমেছে। এই লড়াইয়ে সিপিএম সেনাপতি করেছে সায়নদীপকে।
কলকাতার টালিগঞ্জের মতো উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যুব নেতা ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তীকে। যুব সংগঠনের কলকাতা জেলার সম্পাদক ধ্রুবজ্যোতি। মানিকতলা কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী হয়েছেন আর এক যুব নেতা রাজীব মজুমদার। আবার বেলেঘাটা বামপন্থীদের পুরনো ঘাঁটি। গত বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের হাতছাড়া হয়েছিল এই কেন্দ্র। এ
বারে বেলেঘাটায় সিপিএম প্রার্থী করেছে যুব নেতা রাজীব বিশ্বাসকে। ওই কেন্দ্রে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে আর এক যুব নেতা ইন্দ্রজিৎ ঘোষকে। যিনি ডিওয়াইএফআইয়ের কলকাতা জেলা কমিটির সভাপতি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতায় প্রার্থী করা হয়েছে যুব নেতা বিধান পাড়ুইকে। ওই কেন্দ্রের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে এক যুব নেতা প্রভাত চৌধুরীকে। মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম ধরে রাখার ব্যাপারে আশাবাদী সিপিএম ওই কেন্দ্রে সাংগঠনিক ভাবে নির্বাচন পরিচালনার গুরু দায়িত্ব বর্তেছে ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক জামির মোল্লার উপরে।
এই যুব নেতাদের বয়স তিরিশের আশেপাশে। কয়েক বছর আগেও এঁরা ছাত্র ছিলেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র পুনরুদ্ধারে নিতান্তই কমবয়সী এই নেতাদের উপরে দায়িত্ব দেওয়া কি এক ধরনের ঝুঁকি নেওয়া নয়? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের জবাব, ‘‘মোটেই না! আমরা বামপন্থীরা শুধুই সামাজিক পরিচিতির জেরে কাউকে নেতা বানিয়ে বসিয়ে দিই না। একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরি হয়। নির্বাচনও একটি রাজনৈতিক লড়াই। এই লড়াইয়ের প্রক্রিয়াও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরিতে কাজে লাগাতে চাই।’’ সেই লক্ষ্যেই বাছাই করা কিছু যুব নেতার উপরে ভোটের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত এ বার নিয়েছে সিপিএম।