তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
এক কূটনীতিবিদ বন্ধু একদা জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের ধারণা কতটা ঠুনকো, তার একটা উদাহরণ রাখেন বঙ্গভূমিরই এক বিশেষ সময়পর্বের কথা তুলে এনে। তিনি বলেছিলেন, “মনে করো, একজন লোক ১৯৩০ সালে ঢাকায় জন্মেছেন, তাঁর ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ভারতীয়, পরের ২৫ বছর তিনি পাকিস্তানি, তার পরে তিনি বাংলাদেশি। চার দশকেরও কম সময়ে তাঁর জাতীয়তা তিন বার বদলে গিয়েছে...”
ক্ষণভঙ্গুর জাতিসত্তার এই কাল বহু দিনই অতীত। কিন্তু যদি কেউ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের সময়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখেন, তো তিনি দেখবেন এই বহুচর্চিত বিজেপি-জাগরণের বিষয়টি নয়, আরও বেশি লক্ষণীয় হল এই ভূমিতে রাজনৈতিক আনুগত্যের দ্রুত পরিবর্তনশীলতা। অথচ এক সময়ে বাংলার পরিচিতিই আবর্তিত হত তার রাজনৈতিক বিশ্বস্ততার দ্বারা।
আর একটি বিষয় স্মৃতিরেখায় রণন তুলতে পারে। সেটা হল ‘পরিবর্তন’-এর জিগির। ঠিক ১০ বছর আগে এই ‘পরিবর্তন’-এর ডাকই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করে। সেই জিগিরই আবার এক নতুন চেহারায় আগত। ১০ এপ্রিল বেশ কিছু বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটের বাতাবরণকে যদি ছানবিন করে দেখা যায় তো বোঝা যাবে সেগুলিতে বিজেপি-র পালে একটা ‘হাওয়া’ লেগে রয়েছে। কারণ মানুষ আবার ‘পরিবর্তন’ চাইছেন।
হাওড়া জেলার সাঁকরাইল শিল্পাঞ্চলের এক চায়ের দোকান। আড্ডারত শুভেন্দু মণ্ডলের স্থির বিশ্বাস, এ বছর তাঁদের কেন্দ্রে বিজেপি-ই জিতছে, কারণ তৃণমূলের তলার দিককার কর্মীদের দুর্নীতিতে জনগণ বীতশ্রদ্ধ। “দিদি প্রথম পাঁচ বছর ভাল কাজ করেছিলেন, কিন্তু তার পরে দিদির চেলা-চামুণ্ডারা এত কাটমানি খেয়ে ফেলেছে যে হজম করতে পারছে না”, এই হল মতামত।
‘কাটমানি কালচার’-কে যদি কেউ রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের প্রতি বিদ্বেষের কারণ হিসেবে দেখান, তো চায়ের দোকানে আড্ডা মারা যুবকদের আর একটা অংশ আশা করছেন রাজ্যশাসকের পরিবর্তন নিয়ে আসবে আরও শিল্প, আরও চাকরি বা জীবিকার সুযোগ। কিন্তু সব মিলিয়ে ‘পরিবর্তন’-এর একটা ইচ্ছে জেগে রয়েছে। ‘বিজেপি হাওয়া’-র পিছনে কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে উঠে আসে এমন সব উক্তি, ‘পরিবর্তন দরকার। লোকেরা বলে, আমরা ৩৪ বছর বামকে দেখেছি, ১০ বছর দিদিকে দেখলাম, এ বার একটা নতুন পার্টিকে ট্রাই করি’। সোনারপুর উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের তেঘড়িয়ায় একটা দোকানে বসে ভাস্কর মণ্ডল আরও এক কদম বাড়িয়ে বললেন, “গণতন্ত্রতে বরাবর পরিবর্তন করা উচিত। তা হলেই নেতারা কাজ করে।”
মজার ব্যাপার এখানেই যে, ‘পরিবর্তন’-এর পক্ষে যাঁরা সওয়াল করছেন, তাঁরাই কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে এক অদ্ভুত নেতিবাচক ধারণা ব্যক্ত করছেন। এমন দ্বৈধ মনোভাব বঙ্গ রাজনীতিতে বিরল। এর পিছনে যে শুধুমাত্র এই মানসিকতা কাজ করছে না যে তৃণমূল নেতৃত্বের একটা বড় অংশ পাল্টি খেয়ে বিজেপি-র টিকিটে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ। দলীয় কর্মীরাও শিবির বদল করেছেন, হাওড়ার ঘুশুরির বাসিন্দা, চটকল শ্রমিক গৌরাঙ্গ ঘোষ এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন, “২০১১-র পরে পাড়ার যে সব ছেলেরা সিপিএম করত, তৃণমূল করতে লাগল, এখন তৃণমূলের ছেলেরা বিজেপি-তে যোগ দিয়েছে। ডান্ডা একটা, ঝান্ডা অনেক।”
শুধু মাত্র যে নেতা আর দলীয় কর্মীরা ঝান্ডা বদল করেছেন, এমন নয়। ভোটাররাও মত বদল করেছেন। পূর্ব উলুবেড়িয়া বিধানসভার এক গ্রামের বাসিন্দা মালতী বারিক জানালেন, তাঁর শ্বশুর ছিলেন কট্টর সিপিএম। গোটা পরিবারই বাম সমর্থক ছিল। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর তাঁরা মত বদলান। আর এখন আবার তাঁদের মত আর এক বদলেরই পক্ষে। “যখন যেমন ঢেউ উঠবে, তখন তেমন ভাসতে হবে”, মত মালতীর।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভোট পড়েছিল মাত্র ৭.৪৬ শতাংশ (এর সঙ্গে বিজেপির ঝুলিতে ভোট বেড়ে ৪০.২৫ শতাংশ দাঁড়ায়, দুটো ব্যাপার পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়)। এর একটা স্পষ্ট কারণ এই যে, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর গ্রামবাংলায় বাম সমর্থকদের উপরে যে আক্রমণ নেমে আসে, তার মাত্রা ২০১৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় বেড়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক পাল্টা হাওয়ার পিছনে ‘তৃণমূল সন্ত্রাস’ একমাত্র কারণ নয়। এই ‘ভাসমান ভোটার’-দের উত্থানই এই হাওয়ার পিছনে কাজ করেছে, যা বঙ্গ রাজনীতিতে একটা নতুন ব্যাপার, এ রাজ্যে বিজেপি-র উত্থানের পিছনে একটা বড় কারণ।
তার প্রলম্বিত বিজয়তালিকায় বিজেপি বাংলাকে যুক্ত করতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছে না এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি ভাবছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। সারা দেশের দৃষ্টি এই মুহূর্তে এ রাজ্যের ভোটের দিকেই নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
কিন্তু সত্যিকারের ‘পরিবর্তন’-এর নির্বাচন ছিল ২০১১-র বিধানসভা, যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। বাংলার ‘সাংস্কৃতিক অনন্যতা’ নিয়ে বহু কিছুই লেখা হয়েছে। কিন্তু কার্যত যা এই রাজ্যকে ‘বিশিষ্ট’ করে রেখেছিল, তা এক স্থায়ী রাজনৈতিক নিগড়। বামেদের পিছনে একটা বিশ্বস্ত সমর্থনের ভিত্তি ছিলেন কৃষক ও মফস্সলের বুদ্ধিজীবীরা। বাম-বিরোধী শিবিরেরও একটা বিশ্বস্ত ভোটার বাহিনী ছিল, সেই শিবির জয়ের মুখ না দেখলেও তাঁরা যে ছিলেন, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু কোনও দল বা আদর্শের প্রতি আনুগত্যহীন ‘ভাসমান ভোটার’-এর সংখ্যা ছিল নগণ্য।
২০১১-য় সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনের পরে মমতা যখন বাম মহাশক্তিকে পরাহত করতে সমর্থ হলেন, তখন সেই নিগড় সম্পূর্ণত ভেঙে পড়ে। গত এক দশকে বামেদের গণসমর্থন (দলীয় কর্মীদের কথা হচ্ছে না) একেবারেই ভেঙে পড়ে। এই বি-রাজনীতিকীকরণের ফলেই ‘ভাসমান ভোটার’-দের জন্ম হয়। এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই এই ভাসমান ভোটারদের প্রধান উদ্দেশ্যই হল ‘বিজয়ী পক্ষ’-এর সঙ্গে থাকা, তা সে যে দলই হোক না কেন।
বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টা বাংলায় তাদের জনগ্রাহ্যতা তৈরির পিছনে একটা বড় কারণ অবশ্যই। যাঁরা এখন ‘পরিবর্তন’-এর পক্ষে কথা বলছেন, তাঁরা অনিবার্য ভাবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু তৃণমূল বিরোধিতার পিছনে আরও বেশি করে কাজ করেছে তাদের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ বিষয়ক মনোভাব। আর তার চাইতেও বেশি মাত্রায় ভাসমান ভোটাররা এই ভেবে বিমুখ হয়েছেন যে, তৃণমূল আর ‘বিজেতা দল’ নয়।
এক মাস ব্যাপী ৮ দফা নির্বাচনকে এমন ভাবেই তৈরি করা হয়েছে, যাতে বিজেপি তার জোরের জায়গাগুলো দিয়ে শুরু করতে পারে এবং প্রতি দফায় জানাতে পারে যে সেখানে তারাই জিততে চলেছে। সিপিএম নেতৃত্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট সেই সব জায়গায় ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’-র জিগির তুলতে পারে, যেখানে তাদের সবল প্রার্থী রয়েছেন। যেমন, যাদবপুরে সিপিএমের বর্তমান বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী তাঁর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন। ক্কিন্তু গোটা রাজ্যের দিকে তাকালে ‘নতুন দল’ বিজেপি-র পালেই পরিবর্তনের হাওয়া।
যেটা লক্ষ করার সেটা এই, ভোটারদের অধিকাংশের মুখে যখন ‘পরিবর্তন’-এর বুলি, তখন নরেন্দ্র মোদী যে সেই শব্দটির আগে ‘আসল’ বলে আরও একটী শবদ বসিয়ে রেখেছেন, তা কেউ খেয়াল করছেন না। যদিও তাঁর মুখ সম্বলিত পোস্টারে চতুর্দিক ছেয়ে গিয়েছে, তবু মোদির নাম কিন্তু লোকমুখে তেমন উঠে আসছে না। বদলে যা উঠে আসছে, তা ‘পরিবর্তন’-এর জিগির।
বিজেপি-র গোঁড়া সমর্থক এবং তাঁদের কট্টর বিরোধী পক্ষ, উভয়েই ২০২১-এর নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। রাজ্য তথা দেশের ক্ষেত্রে সদূরপ্রসারী ফলের নির্ণায়ক বলে মনে করছেন। তুলনায় সাধারণ ভোটদাতারা কৌতূহলী হয়ে রয়েছেন মাত্র। ১০ বছর আগে একদা অপরাজেয় বামশক্তির পতনকে দেখার অভিজ্ঞতাঋদ্ধ হয়ে তাঁরা মনে কতছেন, পরিবর্তনই হল নয়া ধ্রুবক। ‘পরিবর্তন’-এর আসল অর্থের দিকে না তাকিয়ে তাঁদের নিঃশঙ্ক অভিব্যক্তি: “ভাল না হলে আবার বদলে দেব।”
এই মনোভাব নেহাতই সরল, কিন্তু এর মধ্যে কোথাও যেন একটা আশার ঘণ্টা টুং টাং বেজে যায়...