তিথি দাস ও হ্যাপি চন্দ
প্রতিবাদের কোনও বয়স হয় না। সাহসেরও কোনও বয়ঃসীমা নেই।
সোমবারের ভোটে এর সাক্ষাৎ-প্রমাণ হয়ে দেখা দিলেন উত্তর দমদম কেন্দ্রের দুই অসমবয়সি ভোটার। উনিশ বছরের কলেজছাত্রী তিথি দাস আর ষাট বছরের হ্যাপি চন্দ। শাসক দলের রক্তচক্ষুকে থোড়াই কেয়ার করে ভোট দিলেন দু’জনেই। দেখিয়ে দিলেন প্রতিবাদটা আসলে সদিচ্ছার জোর আর সাহসটা আত্মশক্তি। তাতে অল্প বয়স বা পরিণত বয়স কোনও বাধা নয়। প্রজন্মের দূরত্বটাও ঘুচিয়ে দেয় সেই সাহস আর শুভ ইচ্ছা।
দাপট দেখাতে ছাড়েনি শাসক শক্তিও। হুমকি-শাসানিতে কাজ হচ্ছে না দেখে তারা বাহুবল প্রয়োগ করেছে ওই তরুণী ও প্রৌঢ় দু’জনের ক্ষেত্রেই।
শাসক দলের কর্মী-সমর্থকেরা তিথির হাত মুচড়ে দেয় ভোটের আগেই। আর ভোট দিয়ে ফেরার পথে মার খেতে হয় হ্যাপিবাবুকে। মাসখানেক আগেই যাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে, হামলাকারীরা ধাক্কা মারে সেই হ্যাপিবাবুর বুকে। হার না-মানার মনোভাবেও উনিশের তরুণী আর ষাটের প্রৌঢ় এক পঙ্ক্তিতে দাঁড়িয়ে। যাবতীয় হুমকি ও চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নিজের নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করেছেন তিথি। আর সেই কাজটা করার পরে যিনি মার খেলেন, সেই হ্যাপিবাবু বলেন, ‘‘মানুষ প্রতিবাদ না-করলে এই সব অপরাধী আরও বেশি সাহস পাবে। আমি এদের ভয় পাই না।’’
ঠিক কী ঘটেছিল এ দিন?
দুর্গানগরের বাসিন্দা তিথি পরিবারের সঙ্গে ভোট দিতে যান উত্তর দমদম বিধানসভা কেন্দ্রের ১১০ নম্বর বুথে। বৈশাখের ভরদুপুরের গনগনে রোদ এড়াতে সাতসকালেই ছুটেছিলেন বুথে। সকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ পরিবারের সঙ্গে বুথের কাছে পৌঁছতেই শুরু হয়ে গেল হুমকি। তিথি জানাচ্ছেন, তিনি তখনও ভোটদাতাদের লাইনে দাঁড়াতে পারেননি। তার আগেই দশ-বারো জনের একটি দল তাঁকে ঘিরে ধরে। তাঁর অভিযোগ, ওরা সবাই এলাকার পরিচিত তৃণমূলকর্মী। চোখ পাকিয়ে তারা তিথিকে সমানে হুমকি দিতে থাকে, ‘এত সকালে এসেছিস কেন? আসতে বারণ করেছিলাম। শুনলি না তো! এর ফল পরে বুঝবি!!’
হুমকিকে তোয়াক্কা করেননি তিথি। এগিয়ে যান বুথের দিকে। তাঁর অভিযোগ, তখনই তাঁর হাত মুচড়ে দেয় এক তৃণমূলকর্মী। তিথি জানান, ওই ব্যক্তি তাঁকে বলে, ‘৩৪ বছর অনেক করেছিস। আর কিছু করতে দেবো না।’ তিথি তখন ওই ব্যক্তিকে পাল্টা বলেন, ‘‘আপনার কি মনে হয়, আমার বয়স ৩৪ বছর?’’
এ কথা শুনে আর নিজের রাগ সামলাতে পারেনি ওই তৃণমূলকর্মী। তিথিকে ঘুষি মারতে যায় সে। কিন্তু পারেনি। রুখে দেন এলাকার মানুষ। একটি মেয়েকে এতগুলো লোক ঘিরে ধরেছে, বাদানুবাদ হচ্ছে দেখে আশপাশের লোকজন চিৎকার শুরু করে দেন। সেই চিৎকার শুনে এগিয়ে আসেন কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা। তিথির কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের আসতে দেখেই ওরা পালিয়ে যায়।’’
পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই ভোট দিতে এগিয়ে যান তিথি। কিন্তু ভোট দিয়ে ফেরার সময় তাঁকে আবার হুমকির মুখে পড়তে হয়। ওই কলেজছাত্রী জানান, এক দল ছেলে তাঁর পিছু নেয়। দেরি করেননি তিথি। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি স্থানীয় থানার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুলিশ এসে তিথিকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
সাহসিনী তিথির কাকা জয়ন্ত দাস বলেন, ‘‘মেয়ের জন্য গর্ব হচ্ছে। ও যে অপরাধীদের কাছে মাথা নিচু করেনি, এটা ভেবে ভাল লাগছে।’’ আর তিথি জানাচ্ছেন, হুমকিটা শুরু হয়েছিল আগের দিনই। শাসক শিবিরের লোকজন পাড়ায় এসে শাসিয়েছিল, ভোট দিতে গেলে ফল ভাল হবে না। ‘‘শাসানিকে তুড়ি মেরে নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছি, এটা ভেবেই ভাল লাগছে,’’ বললেন ওই ছাত্রী।
কবি সুকান্তনগরের বাসিন্দা হ্যাপিবাবুকেও হুমকি দেওয়া হয়েছিল ভোটের আগের দিন। ওই প্রৌঢ়ের অভিযোগ, রবিবার রাতে এক দল তৃণমূলকর্মী তাঁর বাড়িতে এসে শাসিয়ে যায়, ‘সোমবার যেন আপনাকে বাড়ির বাইরে না-দেখি!’
সেই হুমকি উপেক্ষা করে এ দিন সকাল ৬টাতেই বুথে পৌঁছে যান হ্যাপিবাবু। কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে ভোটও দেন। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে তাঁকে ঘিরে ধরে জনা কুড়ি যুবক। হ্যাপিবাবু জানান, ওরা এলাকার পরিচিত তৃণমূলকর্মী। ওদের কয়েক জন তাঁর বুকে ধাক্কা মারে। তিনি রাস্তায় পড়ে যান। তার পরে চলে মারধর। কোনও রকমে পালিয়ে যান ওই প্রৌঢ়। আক্রান্ত ভোটারকে দেখতে যান জোট-প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্য। তৃণমূলকর্মীরা তখন ইট ছুড়ে তাঁর গাড়ির কাচ ভেঙে দেয় বলে অভিযোগ করেন তন্ময়বাবু।
আর হ্যাপিবাবু বলেন, ‘‘হুমকি-মারধরে ভয় পাই না। প্রতিবাদের পথ ছাড়বো না।’’ উনিশের তিথির সুরে এ ভাবেই মিলে যায় প্রৌঢ়ের প্রতিজ্ঞা।