সাংবাদিক বৈঠকে বিজেপি সভাপতি। মঙ্গলবার প্রেস ক্লাবে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
হিম্মত থাকলে নারদ-তদন্তে সিবিআই চেয়ে দেখান!
রবিবার খড়্গপুরে যেখানে শেষ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী, মঙ্গলবার ঠিক সেখান থেকেই যেন শুরু করলেন তাঁর আস্থাভাজন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ।
কলকাতায় এসে তৃণমূল নেত্রীকে সটান চ্যালেঞ্জ ছুড়ে অমিত শাহ বললেন, ‘‘মমতাদি যদি এক বার সিবিআই চেয়ে অনুরোধ করেন, আমরা দেখব, যাতে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ হয়ে যায়!’’ তবে সারদা-তদন্তে মমতার পুলিশই আগাম প্রমাণ লোপাট করে সিবিআইয়ের এগোনোর পথ কঠিন করে দিয়েছে বলে এ দিন অভিযোগ করেন অমিত। তাঁর কথায়, ‘‘সিবিআই একটি স্বতন্ত্র সংস্থা। কিন্তু যে পুলিশ প্রথমে সারদা-তদন্ত করেছে, তারা এমন ভাবে প্রমাণ লোপাট করেছে যে, সিবিআই কেন, কেন্দ্রের কোনও তদন্তকারী এজেন্সির পক্ষেই কাজটা কঠিন হয়ে গিয়েছে।’’
দুর্নীতিকেই যে বিধানসভা ভোটে বিজেপি প্রধান হাতিয়ার করবে, আগেই বুঝিয়েছিলেন মোদী। ‘প্রথমে সারদা, এখন নারদা’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন তৃণমূল নেত্রীকে। যদিও বিরোধীদের প্রশ্ন ছিল, সারদা-তদন্ত কেন গতি হারিয়েছে, তার কোনও জবাব দেননি প্রধানমন্ত্রী। এ দিন কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করেন অমিত। সেখানে তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন। দুর্নীতি নিয়ে সুর চড়িয়েছেন। আবার সারদায় সিবিআই তদন্তে ঢিলেমির অভিযোগ নিয়েও যুক্তি সাজিয়েছেন।
সিবিআইয়ের আগে রাজ্য পুলিশের যে বিশেষ তদন্তকারী দল সারদার তদন্ত করেছিল, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন কলকাতার বর্তমান পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার। ২৪ ঘণ্টা আগে কলকাতা পুলিশেরই এক এএসআই ও কনস্টেবলের বিরুদ্ধে বিজেপি নেতা রাহুল সিংহকে ঘুষ দিতে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাকে নারদের ‘পাল্টা’ স্টিং অপারেশনের চেষ্টা বলেও দাবি করেছেন অনেকে। রাজীব অবশ্য গোটা বিষয়টি থেকেই নিজের দূরত্ব বাড়াতে সচেষ্ট।
তবে সিপিএম-কংগ্রেসের একটা বড় অংশই মনে করে, এই প্রত্যেকটি ঘটনাতেই ‘দিদিভাই-মোদীভাই’ আঁতাঁতের ছাপ স্পষ্ট। ভোটে তৃণমূলের সুবিধে করে দিয়ে বিজেপির ভোট বাড়ানোর লক্ষ্যেই বিজেপি নেতাকে ঘুষ দেওয়ার ঘটনাটি ‘সাজানো’ হল কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। ঠিক একই ভাবে প্রশ্ন উঠেছে
তৃণমূল নেত্রীর ‘নীরবতা’ নিয়ে। লোকসভা ভোটের আগে সারদা-কাণ্ড নিয়ে মোদী যখন খোঁচা দিয়েছিলেন, তখন তাঁর কোমরে দড়ি পরানোর হুমকি দিয়েছিলেন মমতা। সেই তিনিই গত ৪৮ ঘণ্টায় বিজেপি নেতাদের জোরালো কোনও উত্তরই দেননি। কারও নামও নেননি। শুধু বলেছেন, ‘‘বিজেপির নেতারা বাংলাকে অসম্মান করলে আমার থেকে বড় শত্রু কেউ হবে না।’’
‘দোস্তির’ অভিযোগ অবশ্য খণ্ডন করেছে দু’পক্ষই। পুরুলিয়ার সাঁতুড়ির নির্বাচনী সভায় মমতা বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির বন্ধুত্ব কবে ছিল? তৃণমূল সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাস করে। বিজেপি— তোমরা জেনে রাখো, তৃণমূলকে কোনও দিন তোমরা সঙ্গে পাবে না।’’ তেমনই অমিত বলেছেন, ‘‘এ সব ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ মিথ্যে। বিজেপি কখনওই তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলাবে না।’’ এমনকী নয়াগ্রামের সভায় বিজেপি সভাপতি এ-ও বলেন, ‘‘নারদ-কাণ্ডে ঘুষ নেওয়া নেতাদের বহিষ্কার করা উচিত ছিল। কিন্তু মমতাদি তা করবেন না। কারণ, যাঁরা ঘুষ নিয়েছেন, তাঁরা কিছু বলে দিতে পারেন।’’
কিন্তু বিরোধীরা সেই ব্যাখ্যা শুনছেন কোথায়? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘চিট ফান্ডের টাকায় কারা সুবিধাভোগী ছিলেন, তাঁদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে বোঝাপড়ার কারণেই সেই তদন্ত এগোয়নি কেন্দ্র। একই কারণে নারদ নিয়েও তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছে না মোদী সরকার।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কথায়, ‘‘কোন অধিকারে সারদার সিবিআই তদন্ত নিয়ে মন্তব্য করছেন অমিত শাহ? তিনি কি সরকারের প্রতিনিধি? আসলে ঘটনা হল, সারদা থেকে নারদা— এখন মোদীই দিদির ভরসা।’’ অধীরের প্রশ্ন, উত্তরাখণ্ডের স্টিং অপারেশনের সিডি-র ফরেন্সিক পরীক্ষা করিয়েছে কেন্দ্র। তা হলে নারদ-ভিডিওর ক্ষেত্রে তারা কেন হাত গুটিয়ে রয়েছে? এ ক্ষেত্রে অমিতের যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারে। উত্তরাখণ্ডের সিডিটি কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল। তাই সেটি পরীক্ষা করা হয়েছে। ‘‘মমতা দিদি এক বার অনুরোধ করে দেখুন। সঙ্গে সঙ্গে সিবিআই তদন্ত চালু হবে’’— বলেছেন তিনি।
সত্যিটা যা-ই হোক, নারদ নিয়ে মমতা যে উভয় সংকটে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ঘরোয়া আলোচনায় তৃণমূল নেতারাও মানছেন, ২০১৪ এবং ২০১৬ সালের পরিস্থিতি আলাদা। তাই মোদীর আক্রমণ হজম করতে হচ্ছে মমতাকে। প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টা আক্রমণ করে সংখ্যালঘু ভোট সংগঠিত করতেই পারতেন তিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা কাঁচা কাজ হবে। ক’দিন আগেই সারদায় সিবিআই জুজুর মুখে তৃণমূলে ছোটাছুটি পড়ে গিয়েছিল। দলও ছেড়েছিলেন অনেকে। ভোটের মুখে তার পুনরাবৃত্তি নিশ্চয়ই চাইবেন না মমতা। প্রকাশ্যে অমিত শাহ রাজ্য পুলিশের অন্তর্ঘাতের অভিযোগ যতই তুলুন, সিবিআই তদন্ত যে ফের চাঙ্গা হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? সেই সঙ্গে রয়েছে নারদ-হুল। জাতীয় রাজনীতিতে দু’দলের সমীকরণ যা-ই থাক, বিধানসভা ভোটের মুখে রাজ্য বিজেপির চাপও মোদীদের পক্ষে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। সব দিক ভেবেই তাই পা ফেলতে হচ্ছে মোদী ও মমতাকে।