জঙ্গলমহল হাসছে? সাবধানী গলা বলে, ‘দেখা যাক’

শালের বনে ফুল ধরেছে! যেন পাল্টে গিয়েছে দুয়ারসিনি। চৈত্রের ভরদুপুরের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় শালের ফুল ঝরে ঝরে পড়ছে গায়ে-মাথায়। মহুলের গন্ধ জঙ্গল জুড়ে। চৈত্রের ঝরা পাতা হাওয়ায় গড়াতে গড়াতে নানা কথা বলে যায়।

Advertisement

তাপস সিংহ

বান্দোয়ান শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ১৯:৪৩
Share:

মাওবাদীদের আক্রমণের শিকার অতিথি নিবাস উমুল। —নিজস্ব চিত্র।

শালের বনে ফুল ধরেছে!

Advertisement

যেন পাল্টে গিয়েছে দুয়ারসিনি।

চৈত্রের ভরদুপুরের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় শালের ফুল ঝরে ঝরে পড়ছে গায়ে-মাথায়। মহুলের গন্ধ জঙ্গল জুড়ে। চৈত্রের ঝরা পাতা হাওয়ায় গড়াতে গড়াতে নানা কথা বলে যায়।

Advertisement

ভাল করে ঠাহর করলে বোঝা যায়, পাল্টেছে আরও অনেক কিছুই।

বেশ কিছু দিন পরে দুয়ারসিনিতে পা দিয়ে সাতগুরুম ঝোরার কাছের সেই প্রস্তরফলকটা চোখে পড়ল না। ঝোরার পাশের একটি দোতলা বিশাল বাড়ির সামনেই ছিল সেই ফলক। দোতলা সে বাড়ির চারটি স্তম্ভেই গভীর ফাটল। ধসে পড়ে আছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। দেওয়ালগুলির গা-ও দ্বিধান্বিত ভাবে ফুটিফাটা। বাড়িটা যেন কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে থেকে ইতিহাসের এক অনালোকিত অধ্যায় পড়ে শোনাতে চায়।

মনে পড়ে যায়, সেই প্রস্তরফলক জানিয়েছিল, ১৪১০ বঙ্গাব্দের ১৫ জৈষ্ঠ্য, ইংরেজি ২০০৩-এর ৩০ মে ‘উমুল’ নামে এই অতি‌থি নিবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন যিনি, সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে দলের প্রাণপুরুষ সেই রবীন্দ্রনাথ কর ও তাঁর স্ত্রী আনন্দময়ীকে মাওবাদীরা বাড়িতে ঢুকে গুলি করে, পুড়িয়ে মেরেছিল। বাড়ির বাইরে কার্বাইনধারী দু’-দু’জন নিরাপত্তারক্ষী থাকা সত্ত্বেও। দুয়ারসিনির অদূরে ভোমরাগড়া গ্রামে রবিবাবুর মা, নবতিপর দুলালী করের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, কেমন আছেন জানতে। না গেলেই হয়তো ভাল হত। পুত্র ও পুত্রবধূর এই নৃশংস হত্যার পরে আর কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না বৃদ্ধা। এ বারে আর সেই প্রয়োজন পড়েনি। এই অতিথি নিবাস যাতে নিরাপত্তারক্ষীদের ডেরায় পরিণত না হয়, সে জন্য মাওবাদীরা জিলেটিন স্টিক দিয়ে সেটি উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।

কিন্তু পাল্টে গিয়েছে সেই দুয়ারসিনি। আপাতত, শান্তিকল্যাণ!

সাতগুরুম লাগোয়া চত্বরের উঁচু-নিচু ঢালে শনিবারের হাট বসেছে দুয়ারসিনিতে। লু্কাপানি, বড়াপানি, আসনপানি, বান্দোয়ান, মানবাজার থেকেও মানুষজন এসেছেন খেতের উচ্ছে-বেগুন-লাউ-টম্যাটো নিয়ে। বিকোচ্ছে ঝুড়ি-বন্দি দেশি মুরগি, বেতের ঝুড়ির পাশাপাশি হাড়িয়াও। দূরের গালুডি, ঘাটশিলা থেকে ব্যাপারীরা এসেছেন বিকিকিনির এ হাটে। সওদা করে যাবেন জামশেদপুরের বাজারে। ‘ওখানে পয়সা বেশি পাওয়া যায়’, বলছেন কারবারিরা।

ভোট আসছে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই দুয়ারসিনি, আসনপানিতেও। হাটের পথে দেখা লুকাপানি গ্রামের অমূল্যরতন সিংহ সর্দারের সঙ্গে। আগে তাঁদের গ্রামে গিয়েছি পায়ে হেঁটে খরস্রোতা সাতগুরুমের জল পেরিয়ে। এ বারে অবশ্য পার হওয়া গিয়েছে কংক্রিটের সাঁকো দিয়ে। ২০১২-’১৩-য় ইনক্রিমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যানের (আই এ পি) টাকায় সেই মিনি ব্রিজ তৈরি হয়েছে। ভোটের তেমন প্রচার নেই এই প্রত্যন্ত এলাকায়। জলের হাল অবশ্য প্রায় একই রকম থেকে গিয়েছে। লুকাপানি গ্রামের পাহাড়কোল, মাঝবস্তি, পোড়াডি— এই তিনটি টোলায় দু’টি নলকূপ। আর ’৬২ সালে তৈরি কুয়ো থেকে কোনওক্রমে একটু জল পান তাঁরা। ৬০-৬৫ ঘরের জন্য সেটুকু যথেষ্ট নয় বলেই মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত এই প্রাথমিক শিক্ষক। দু’টাকা কিলোর চালের মান নিয়ে যেমন, একশো দিনের কাজ নিয়েও দুয়ারসিনির তেমনই বিস্তর অভিযোগ।

এই লুকাপানিতেই চার পুরুষের বাস অমূল্যবাবুর। শালের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘‘এখান থেকে বান্দোয়ান ১৫ কিলোমিটার রাস্তা ’৬৯ সালে হেঁটে যেতাম, রাস্তা বলে কিছু ছিল না। এখন তো অনেক কিছুই হয়েছে। আবার অনেক কিছু হারাতেও দেখলাম।’’

তীব্র আতঙ্ক আর নিরন্তর রক্তস্রোতের আবহে দুয়ারসিনি হারিয়েছে অনেক কিছুই। একের পর এক সিপিএম নেতা-কর্মী খুন, বান্দোয়ানের তৎকালীন ওসি নীলমাধব দাসের হত্যা, গুড়পানায় নির্মীয়মাণ পুলিশ ক্যাম্পে বিস্ফোরণ, খতম তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। আর তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বান্দোয়ান কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী রাজীবলোচন সরেন বলতেই পারেন, ‘‘এখন কোথাও কোনও আতঙ্ক নেই। সব পাল্টে গিয়েছে। এখন নির্ভাবনায় সবাই সব দিকে যেতে পারে।’’

কিন্তু, সবাই কি আর ততটা নির্ভাবনায় থাকে? সিপিএমের বান্দোয়ান জ‌োনাল কমিটির সম্পাদক রতু সিংহ যেমন বলেন, ‘‘মাওবাদীদের থেকেও ভয়ঙ্কর তৃণমূল।’’ কেন? তাঁরা কি নিশ্চিন্তে প্রচার করতে পারছেন না? ‘‘না, তা নয়। আসলে জনগণ সঙ্গে আছে। তা‌ই আমরা বুথভিত্তিক প্রচার চালাচ্ছি। সূর্যকান্ত মিশ্রের সভায় লোক দেখলেন?’’ পাল্টা প্রশ্ন তাঁর। জঙ্গলমহলের এই বান্দোয়ান (সংরক্ষিত) আসনটি গত বার ‘পরিবর্তন’-এর ঝড়েও দখলে রাখতে পেরেছিল সিপিএম। এ বারেও কি তাই হতে পারে? জঙ্গলমহল যেখানে হাসছে!

সন্দেহ জিইয়ে রেখেছে জঙ্গলমহল। জানাচ্ছে, ‘দেখা যাক, কী হয়।’

যেমন, জিইয়ে রেখেছে সেই সন্দেহও। ‘বনপার্টি’র লোকেরা আসে এখনও? মিটিং করে রাতের অন্ধকারে?

ঝাড়খণ্ডের একেবারে লাগোয়া দুয়ারসিনি বা হরকাদহ, হোসেলহুটু, পোড়োবেড়া পাহাড়ের কোলে চুপটি করে বসে থাকা আসনপানি গ্রাম সাবধানী গলায় বলে ওঠে, ‘দেখা যাক, কী হয়।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement