গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তিনি এক বারই জিতেছেন। তবু মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের নাম উঠলে এখনও দিলীপ ঘোষের কথাই ওঠে। এই আসন থেকেই রাজ্য সভাপতি থাকার সময়ে নিজে জিতেছেন এবং রাজ্যে ১৮টি আসনে দলকে জিতিয়েছেন দিলীপ। কিন্তু এ বারে লোকসভা ভোটে সেই দিলীপ মেদিনীপুরের টিকিট পাননি! বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভায় প্রার্থী হয়ে দিলীপ জিতবেন কি না, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু মেদিনীপুর না পেয়ে দিলীপ যে ভোটের আগেই নিজের দলের কাছে হেরেছেন, তা মানতে হবে।
দিলীপের জায়গায় টিকিট পেয়েছেন দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। অতীতে আসানসোল লোকসভার উপনির্বাচনে তৃণমূলের শত্রুঘ্ন সিন্হার কাছে হেরেছিলেন অগ্নিমিত্রা। তবে দলে তাঁর উত্থানের লেখচিত্র শেয়ার বাজার চাঙ্গা হওয়ার মতো। প্রথমে মহিলা মোর্চার রাজ্য সভনেত্রী। তার পরে রাজ্যের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। তার পরে বিধায়ক। এ বার জেতা আসনে সাংসদ হওয়ার যুদ্ধে। পেশায় পোশাকশিল্পী হলেও এখন পুরোদস্তুর রাজনীতিক অগ্নিমিত্রার লড়াই শুধু জেতার জন্য নয়, দিলীপের থেকেও বেশি ভোটে জেতার জন্য। গণতন্ত্রে এক ভোটে জয়ও সমান মূল্যবান। কিন্তু গণতন্ত্র বলেই তুলনাও আসবে। সেই তুলনা হবে বিজেপির অন্দরে। ‘আদি’ বনাম ‘নব্য’ বিজেপির অদৃশ্য লড়াইও রয়েছে মেদিনীপুরে।
মেদিনীপুরে দিলীপের জয় আচমকা এমন বলা যাবে না। অতীতে জয় না পেলেও এই আসনে একাধিক বার দ্বিতীয় হয়েছে বিজেপি। আবার খড়্গপুর সদর আসনে বরাবরই পদ্মের একটা ‘পকেট ভোট’ ছিল। রেলশহর থেকে দিলীপই ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে জিতেছিলেন। এখনও সে আসন বিজেপির। ২০২১ সালে নীলবাড়ির লড়াইয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই একটি আসনেই জিতেছিল পদ্ম। জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন অভিনেতা হিরণ চট্টোপাধ্যায়। যিনি এ বার লোকসভা ভোটে প্রার্থী হয়েছেন ঘাটালে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মেদিনীপুর স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের হাতে থাকলেও এক বার এই আসন থেকে ভারতীয় জনসঙ্ঘের দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জিতেছিলেন। ১৯৮০ সাল থেকে টানা জিতেছিল কাস্তে-ধানের শিষ। সিপিআই প্রার্থী নারায়ণ চৌবেকে দিয়ে শুরু। পরে টানা পাঁচ বার জিতেছেন ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। সিপিআইয়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া এবং আইকে গুজরাল সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন মেদিনীপুরের সাংসদ হিসাবেই। আমৃত্যু সাংসদ থাকার পরে তাঁর উত্তরসুরী হিসাবে মেদিনীপুরের সাংসদ হয়েছিলেন সিপিআইয়েরই প্রবোধ পন্ডা।
২০০৯ সালের প্রবল তৃণমূল হাওয়ার মধ্যেও জিতেছিলেন প্রবোধ। অধুনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র সমালোচক তথা প্রাক্তন আমলা দীপক ঘোষকে হারিয়ে শেষ বার মেদিনীপুরের সাংসদ হন প্রবোধ। তবে দিন যে ফুরিয়ে আসছে, তা বোঝা গিয়েছিল সেই ভোটেই। অতীতে মেদিনীপুরে লাখ লাখ ভোটের ব্যবধানে জেতা সিপিআই সে বার জিতেছিল মেরেকেটে ৫০ হাজারে। ২০১৪ সালে প্রবোধ তৃণমূলের কাছে হারেন ১,৮৬,৬৬৬ ভোটে। তাঁকে হারালেন অভিনয় জগৎ থেকে প্রথম ভোট রাজনীতিতে আসা সন্ধ্যা রায়। এর পরে অবশ্য তৃণমূল সন্ধ্যাকে আর প্রার্থী করেনি। কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে এসে রাজ্যসভার সাংসদ হওয়া মানস ভুঁইয়াকে ২০১৯ সালে প্রার্থী করেছিল তারা। তবে লোকসভার সদস্য হওয়া হয়নি মানসের। দিলীপের কাছে হারেন প্রায় ৮৯ হাজার ভোটে। এখন তিনি তৃণমূলের টিকিটে তাঁর ‘ঘর’ সবং বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হয়ে রাজ্যের মন্ত্রী। তবে তাঁর প্রভাব কমেছে রাজ্য রাজনীতিতে।
দিলীপ প্রথম বার মেদিনীপুরে বিজেপির জয় নিয়ে এলেও ইতিহাস বলছে, অতীতে একাধিক বার এই কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেছিল বিজেপি। তবে সেটা তৃণমূলের সঙ্গে জোট বেঁধে। ১৯৯৯ সালে এই আসনে পদ্মপ্রার্থী মনোরঞ্জন দত্ত ৪৫.৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। সে বার ইন্দ্রজিৎ পেয়েছিলেন ৪৮.৬০ শতাংশ। ২০০৪ সালে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ ৩৫.১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। তার ১৫ বছর পরে দিলীপ পান ৪৮.৬২ শতাংশ ভোট। তাই একক ভাবে (কারও সঙ্গে জোট না বেঁধে) লড়াই করে বিজেপির সভাপতি হিসাবে মেদিনীপুর জয় দিলীপের কাছে শ্লাঘার বিষয়ও বটে।
মানসের রেখে যাওয়া পুঁজি নিয়েই লড়াইয়ে নেমেছেন তৃণমূল প্রার্থী জুন মালিয়া। অভিনেত্রী জুন ২০২১ সালে মেদিনীপুরের বিধায়ক হয়েছেন। এ বার বড় ময়দানে লড়াই তাঁর। জুনের পক্ষে আশা ২০২১ সালের নীলবাড়ির লড়াইয়ের ফলাফল। দিলীপের জয়ের সময়ে এই কেন্দ্রের ছ’টি বিধানসভায় তৃণমূল পিছিয়ে থাকলেও এখন ছ’টিতেই এগিয়ে। জুনকে তৃণমূল প্রার্থী ঘোষণার পরে তাঁকে দু’লক্ষ ভোটে হারানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন দিলীপ। কিন্তু নিজেই টিকিট না-পাওয়ায় বলেন, ‘‘মেদিনীপুরের মাটি তৈরিই রয়েছে। আমি সেটা করে রেখেছি। মানুষ ভোট দেবেন মোদীজিকে দেখে। আমি মনে করি শুধু লড়াই দেওয়া নয়, অগ্নিমিত্রার জয় নিশ্চিত।’’ অগ্নিমিত্রা বলেন, ‘‘দিলীপদার আশীর্বাদ নিয়েই এসেছি। তিনিই আমায় মহিলা মোর্চার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।’’
তবে দৃশ্যত অগ্নিমিত্রা আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন কাঁথির ‘শান্তিকুঞ্জে’। দলের মনোনয়ন পাওয়ার পরে পরেই গৃহকর্তা তথা কাঁথির বিদায়ী সাংসদ শিশির অধিকারীর কাছে। মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রে যে সাতটি বিধানসভা রয়েছে, তার মধ্যে এগরা পড়ে পূর্ব মেদিনীপুরে। বাকি ছ’টিই পশ্চিম মেদিনীপুরে। তাই অগ্নিমিত্রার শান্তিকুঞ্জে গমনকে বিজেপির অন্দরের ‘দ্বন্দ্ব’ প্রকাশ্যে এসে পড়া বলে দাবি করেছিল তৃণমূল। দাবির পিছনে তাদের যুক্তি ছিল। এ বার মেদিনীপুরে দিলীপের পরিবর্ত হিসাবে অগ্নিমিত্রাকে নিয়ে আসার পিছনে যে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর হাত আছে, সে আলোচনা পদ্মশিবিরেই রয়েছে। যদিও ‘আনুগত্য’ প্রকাশের অভিযোগ উড়িয়ে অগ্নিমিত্রা বলেছিলেন, ‘‘আমি দিলীপদার যতটা অগ্নিমিত্রা, ততটাই শুভেন্দুদা এবং সুকান্তদারও অগ্নিমিত্রা।’’ একই সঙ্গে দিলীপের মতোই লড়াকু মেজাজ দেখিয়ে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপের ডিপিতে নিজের ছবির বদলে লিখেছিলেন, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।’
সেই মেদিনীতে সিপিআই এ বার প্রার্থী করেছে বিপ্লব ভট্টকে। কংগ্রেস প্রার্থী ঘোষণা করলেও মনোনয়ন জমা দেয়নি। প্রার্থী নিয়ে জেলা কংগ্রেসের আপত্তির জেরেই এমন সিদ্ধান্ত। টানা রক্তক্ষরণে ২০১৯ সালে সিপিআইয়ের ভোট কমে হয় ৪.৪২ শতাংশ। তবে এ বার রামে যাওয়া বামের ভোট ‘ঘর ওয়াপসি’ করবে বলে দাবি বিপ্লবের। কিন্তু সেটা কতটা? তাতে কি ‘বৈপ্লবিক বদল’ আনতে পারবেন বিপ্লব! কারণ, মেদিনীপুরে রাম দুই ফুলেরই। জেলা শহরের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে কংসাবতী। এলাকার মানুষ আদর করে ডাকেন কাঁসাই। সেখানে সদ্যই নতুন করে রাম-সীতা-হনুমান মন্দির তৈরি হয়েছে। সোজাসুজি না হলেও পাশে ছিল তৃণমূল পরিচালিত পুরসভা। অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধনের দিন কয়েক আগেই মকর সংক্রান্তির দিনে সেই মন্দিরের উদ্বোধন করেন তৃণমূলের বিধায়ক তথা প্রার্থী জুন। অযোধ্যার সরযূর মতো কাঁসাইয়ের পারেও হয় আরতি।
রামনবমী পালন করেছে যুযুধান তৃণমূল বিজেপি দুই শিবিরই। দু’পক্ষের আয়োজনেই ধুমধাম ছিল। গেরুয়া শিবিরের মুখে ছিল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। আর ঘাসফুল শিবির বলেছে, ‘জয় সীতারাম’ স্লোগান। সূচ্যগ্র মেদিনীর লড়াই কি তবে স্রেফ রাম ভরসায়!