(বাঁ দিকে) অরবিন্দ কেজরীওয়াল এবং রাহুল গান্ধী (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
“রাহুলজি আসার পর বিক্রি কিছুটা বেড়েছে এটা মানতেই হবে। শুধু আমার বেড়েছে তা নয়, এই রাস্তা দিয়ে খানিকটা এগিয়ে যান, ‘মহব্বত কা শরবত’ নামে রাস্তায় নানা রকম পানীয়ের স্টল বসে গিয়েছে গত এক বছরে! লোকে সেখানেও যাচ্ছে। তবে আমাদের দোকান বহু প্রাচীন, একশো পঁচিশ বছর হতে চলল,” বললেন ‘আদি’ মহব্বত কা দুকানের মালিক ওয়াজির।
গত কয়েক দিন হল প্রখর তাপপ্রবাহ রাজধানীতে। দুপুরে শহরের অন্য বাজারে ভিড় কম হলেও হতে পারে। কিন্তু জামা মসজিদের ইতিহাসপ্রাচীন সিঁড়ি থেকে পায়রা ওড়া দূরত্বের এই সঙ্কীর্ণ রাস্তায় ধাক্কা না লাগিয়ে চলতে পারলে পুরস্কার আছে! আয়তনের হিসাবে দেশের সবচেয়ে ছোট, ১৯৫৬ সালে তৈরি এই চাঁদনি চক লোকসভা কেন্দ্র। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাটিকে দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভূগোলের একটি খণ্ডচিত্র বললেও বোধহয় ভুল হয় না। বেচাকেনায় এবং সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক তাৎপর্যে দিল্লিতে এর বিশেষ জায়গা।
গত বছর রমজানের সময় হঠাৎই বিনা নোটিসে এই শরবতের দোকানে এসে তরমুজ আর দুধ দিয়ে তৈরি ‘ভালবাসার শরবত’ খেতে খেতে, ওয়াজিরের ব্যবসার খোঁজখবর নিয়েছিলেন রাহুল। আজ ওয়াজির বলছেন, “ওঁকে তখন বেশি কিছু বলতে পারিনি। এতটাই আচমকা এসেছিলেন, সঙ্গে আরও লোক ছিল। তবে ব্যবসার হাল কোভিডের পর থেকে সেই যে পড়তির দিকে, আর ওঠেনি।” পারিবারিক সূত্রে জামাকাপড়ের দোকান ছিল ওয়াজিরদের। শরবত সরবরাহ করতেন রমজান, ঈদ, আরও অন্যান্য অনুষ্ঠানে। কোভিডের সময় আক্ষরিক অর্থেই ইঁদুরে খেল কাপড়ের ব্যবসা। ওয়াজির এখন বলছেন, “জিনিসের দাম এত বেড়ে গিয়েছে, আমাদের পড়তায় পোষাচ্ছে না। তাও কেজরীওয়াল বাড়িতে বিজলি আর দোকানে পানির কর মকুব করায় সোজা দাঁড়িয়ে রয়েছি এখনও।”
নোটবন্দিতে যা চোট পেয়েছিলেন, তার ক্ষত এখনও শুকোয়নি। সদর বাজারের চশমার হোলসেল ব্যবসায়ী শাফিকুল রহমান বলছেন, ‘‘আমরা যেহেতু গোটা দেশে পাইকারি ব্যবসা করি, জিএসটি-তে আমাদের তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ঘরের মহিলাদের যা পুঁজি জমানো ছিল, সব খালি হয়ে গিয়েছে। তার পর করোনার চোট। দাদি-খালা-নানীদের বদ দুয়া এ বার মোদীর সঙ্গে। তবে শুধু গত কয়েক মাস নয়, সর্বদা এখানকার আপ নেতারা আমাদের সঙ্গে আছেন।’’
বাতাসে একই সঙ্গে উড়ছে ক্ষোভ আর আশার কথা। তবে আসাদউল্লা খান বেগ তথা মির্জা গালিবের বল্লিমরান মহল্লা— যাকে মনে করে গুলজ়ার লিখেছিলেন, ‘বল্লিমরান মহল্লে কি উও পেচিদা দলিলোঁ কি সি গলিয়াঁ’— আজ এই খরতাপ দুপুরে সেই পাড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হল, রাহুল-কেজরীওয়ালের যুগলবন্দিতে কিছুটা ভরসা তৈরি হচ্ছে সংখ্যালঘু মনে। তেলেভাজা, রুহ আফজা, কাবাব, ভাল্লা পাপড়ি— এলাকা জুড়ে সেই প্রাচীন গন্ধের রকমফের নেই। এই চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে যেন ফ্রিজ় শট হয়ে নিজের আসনে বসে রয়েছেন চপ্পলের দোকানের মালিক মহম্মদ ফারুকি। “এ বার তো ভোটবাবুরা আসেননি এখনও। হয়তো ভোটের আগের দিন আসবেন। আমাদের গুজরান নিয়ে কার মাথাব্যথা বলুন তো? তবে একটা ভাল হয়েছে, আমাদের ভোট এ বার নষ্ট হবে না, ভাগও হবে না। বিজেপি প্রতি বার এই ভাগের কারণে সুবিধা পেয়ে গিয়েছে। আপ-কংগ্রেস এক হওয়ায় বিজেপি প্রার্থীর চাপ আছে। মুসলিমদের তো চোখ তুলে তাকানোরও অধিকার নেই এই মহল্লার বাইরে।”
তবে এই নির্বাচনী কেন্দ্র থেকেই গত লোকসভা নির্বাচনে হাসতে হাসতে জিতেছিলেন বিজেপি প্রার্থী হর্ষবর্ধন। এ বার তিনি সরে দাঁড়ানোয় বিজেপির নতুন বেনে প্রার্থী খণ্ডেলওয়াল। যাঁর বাণিজ্যমহলে বিরাট প্রতিপত্তি এবং অর্থবল রয়েছে। অন্য দিকে ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থী বহু পুরনো, ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে কংগ্রেস করছেন এবং এই এলাকায় বড় হওয়ার কারণে নির্বাচনী ক্ষেত্রটি চেনেন হাতের তালুর মতো। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে যিনি মুসলিমও নন। কংগ্রেসের এই জয়প্রকাশ আগরওয়াল চাঁদনি থেকে জিতেছেন তিন বার, যথাক্রমে ১৯৮৪, ১৯৮৯ এবং ১৯৯৬ সালে। এখানকার অনেক যুবা ও মধ্যবয়সী দোকানদারই জানাচ্ছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই’ আগরওয়ালকে তাঁরা চেনেন বা দেখেছেন দায়ে দফায়।
চাঁদনি চক, বল্লিমারান, চাওড়ি বাজার হয়ে জামা মসদিজ পর্যন্ত হেঁটেও এগোনো মুশকিল, রাস্তা এতটাই ঘিঞ্জি। স্থানে স্থানে রাস্তাঘাট প্রায় নরক। স্থানীয় দোকানদাররা বলছেন, পুরনো হয়ে যাওয়া নালা নর্দমা ফেটে জল উপচে পড়ে মাঝে মাঝেই পূতিগন্ধময় হয়ে যায় গোটা এলাকা। ‘‘কারও কোনও হেলদোল নেই। এমনিতেই এই ডিজিটাল যুগে বিয়ের কার্ড ব্যাপারটাই উঠে যাচ্ছে। তার মধ্যে দোকানের সামনে এই দুর্গন্ধ’’, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিরক্ত ‘নবরতন ওয়েডিং কার্ড’-এর মালিক আর সুনীল কুমার জৈন। পাশাপাশি অন্তত গোটা দশেক কার্ডের দোকান একই ভাবে মাছি তাড়াচ্ছে। ‘‘নোটবন্দি যখন হয়েছিল তখন ভরা বিয়ের মরসুম। লোকের হাতে সে সময় বিয়ে করার টাকাই নেই তো কার্ডের অর্ডার কী দেবে! সেই যে শুরু হল হোয়াটসঅ্যাপে নেমন্তন্ন, এখনও সেটাই চলছে।’’ অথচ মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্ব নিয়ে জানতে চাওয়ায় আকাশ থেকে পড়লেন সদর বাজারে সত্তর বছরের প্রাচীন মনিহারি দোকান ‘নিউ ভারত স্টোর’-এর মালিক অরুণ পাণ্ডে। “দেখুন, আমরা গোটা দিনে যদি একশো জন খদ্দের পাই, তার মধ্যে অন্তত আশি জন সস্তার জিনিস ছেড়ে দামিটা নেয়। তা সে পাউডার হোক বা সান ক্রিম। চপ্পল পরে এসে মোবাইলে পে করে চলে যায়। লোকের হাতে টাকা না থাকলে কি হত এটা?” দোকান সংলগ্ন এলাকায় পাঁউরুটি, বান, শিমুইয়ের কাউন্টার খুলে বসেছেন অরুণের ভাইপো, সন্তোষ পাণ্ডে। তিনি বলছেন, “কম্পিউটার নিয়ে পড়াশুনো করেও এই ব্যবসা করছি, কারণ কাটতির কোনও অভাব নেই। যা মাইনে পেতাম, তার তিন গুণ কামাচ্ছি মাসে।”
সিপাহি বিদ্রোহের পরে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া গালিব দিল্লির ভাঙন দেখতে দেখতে এক দিনলিপি লিখেছিলেন। দিল্লির পতনে বিষণ্ণ কবি বলেছিলেন, ‘কেল্লা, চাঁদনি চক, গিরিন্দা বাজার, জুম্মা মসজিদ, প্রতি বছর ফুলওয়ালাদের মেলা— এই পাঁচ-পাঁচটি জিনিসই যখন নেই, তখন বলো, দিল্লি শহরটা কোথায়?’
ব্যস্ততা আর অঢেল প্রাণশক্তিতে টগবগে চাঁদনি চকের প্রতিটি গলি, প্রতিটি দোকান, প্রতিটি দোকানদারের কাছে একটি করে গল্প রয়েছে বলার জন্য। লোকসভা ভোটের আয়নায় চাঁদনি চক নিজেকেই খুঁজছে বলে মনে হল ফিরে আসার সময়।