আরাবুল ইসলাম। —ফাইল চিত্র।
দিল্লির দৌড়ে কে কোথায়? কোন দল কী ভাবে ঘর গোছাচ্ছে? কোথায় কোন কাঁটা বেগ দিচ্ছে কাকে? লোকসভা ভোটের আগে বিধানসভা ভিত্তিক খোঁজখবর। সেই সঙ্গে কোন বিষয়গুলি মাথায় রেখে বুথমুখী হবেন ভোটার, সে দিকে নজর রাখল আনন্দবাজার।
আইএসএফ কর্মী খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জেলে রয়েছেন ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম। আর এক প্রভাবশালী নেতা কাইজার আহমেদকে সাংগঠনিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এত দিন ভাঙড়ে শাসক দলের হয়ে ভোট সামলাতেন মূলত আরাবুল-কাইজারই। দুই নেতার অনুপস্থিতে এ বার লোকসভা নির্বাচনে ভাঙড় বিধানসভার ফল কী হবে, তা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে তৃণমূলের অন্দরে।
তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে ভাঙড়ে দলের দায়িত্বে ছিলেন আরাবুল। ২০০৬ সালে তিনিই প্রথম সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করে ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন। ২০১১ সালে তিনি হেরে যান। জয়ী হন সিপিএম প্রার্থী বাদল জমাদার। ২০১৬ সালে সিপিএমের প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা তৃণমূলের টিকিটে এই কেন্দ্র থেকে জেতেন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আবার ভাঙড় তৃণমূলের হাতছাড়া হয়। জয়ী হন রাজনীতিতে নবাগত, আইএসএফের নওসাদ সিদ্দিকী।
বিধানসভায় জয়ের পরেই এক সময়ের তৃণমূলের দুর্গ ভাঙড় কার্যত আইএসএফের দখলে চলে যায়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন পর্ব থেকে তৃণমূল-আইএসএফের রাজনৈতিক সংঘর্ষে বার বার উত্তপ্ত হয়ে উঠে ভাঙড়। মনোনয়ন পর্ব থেকে গণনার দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক হিংসায় মৃত্যু হয় সাত জনের। এর মধ্যে চার জন আইএসএফ কর্মী ও তিন জন তৃণমূল কর্মীর মৃত্যু হয়। পঞ্চায়েত ভোটে কিছু এলাকায় ভাল ফলও করে আইএসএফ।
এই পরিস্থিতিতে লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে শাসক দলের কাছে। তবে তৃণমূলের অন্দরের খবর, এলাকায় দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত। আরাবুল-কাইজারের অনুপস্থিতে সব নেতারা দলের পর্যবেক্ষক সওকাত মোল্লার হাত ধরে এক ছাতার নীচে আসলেও নিচুতলার কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত।
এ বার যাদবপুর লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী করেছে অভিনেত্রী সায়নী ঘোষকে। এর আগে এই কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছিলেন অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। তার আগে এই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হন অধ্যাপক সুগত বসু, গায়ক কবীর সুমন। স্থানীয় মানুষের একাংশের অভিযোগ, অতীতে এই সমস্ত প্রার্থীর কাছ থেকে ভাঙড়ের মানুষ সেই ভাবে কোনও সুযোগ-সুবিধা পাননি। সাংসদ তহবিলের টাকায় ভাঙড়ের কোথায় কী উন্নয়ন হয়েছে, তা-ও চোখে পড়ে না বলেই অভিযোগ এলাকার অনেকের। বাসিন্দাদের দাবি, প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনও কাজই হয়নি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভাঙড়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নতি করা হয়নি। বিজয়গঞ্জ বাজারের কাঠের সাঁকোটি আজও কংক্রিটের হয়নি। বিভিন্ন খালের উপরে কাঠের সাঁকোগুলো পাকা করা হয়নি। তা ছাড়া, ভাঙড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থারও তেমন উন্নতি হয়নি বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
এ বার এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী হয়েছেন অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়। সিপিএম প্রার্থী করেছে ছাত্র নেতা সৃজন ভট্টাচার্যকে। গত বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম ও আইএসএফের জোট হয়েছিল। এ বার অবশ্য এখনও পর্যন্ত আইএসএফ ও সিপিএমের সমঝোতা হয়নি। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই সমাধান সূত্রে বেরোবে বলে আশাবাদী দু’পক্ষই। এর মধ্যেই কয়েক দিন আগে দেওয়াল লেখাকে কেন্দ্র করে এক আইএসএফ কর্মীর জখম হওয়ার খবর পেয়ে এলাকায় যান সিপিএম প্রার্থী সৃজন। পাশে থাকার আশ্বাস দেন। রাজনৈতিক মহলের মতে, সিপিএম-আইএসএফ সমঝোতা না হলে সুবিধা পাবে শাসক দলই।
বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকী বলেন, “আমরা বেশ কিছু আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছি। বামেদের সঙ্গে কিছু আসন নিয়ে আলোচনা চলছে। আশা করছি দ্রুত সমঝোতা হয়ে যাবে। আমাদের লড়াই তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে। ভাঙড়ে আমাদের সংগঠন শক্তিশালী। আমরা ঐক্যবদ্ধ লড়াই চাইছি।”
সিপিএম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য বলেন, “এখন ভাঙড়ের ভোট ব্যাঙ্ক শাসক বিরোধীদের। গত বিধানসভা নির্বাচন থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ভাঙড়ের মানুষ কাদের ভোট দিচ্ছেন। ভাঙড়ের মানুষের মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে যাদবপুর আমরা দখল করব।”
বিজেপি প্রার্থী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভাঙড়ে কোনও কাজ হয়নি। আমরা ক্ষমতায় এলে ভাঙড়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, বানতলা চর্মনগরীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সমস্ত উন্নয়নমূলক কাজ করব। তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ ভোট দেবেন। আমরা জেতার ব্যাপারে আশাবাদী।”
যদিও ভাঙড়ের তৃণমূলের পর্যবেক্ষক সওকাত মোল্লা বলেন, “ভাঙড়ের মানুষ আমাদের সঙ্গেই আছে। দু’এক জন কী বলল তাতে কিছু এসে যায় না। ভাঙড় থেকে আমরা পঞ্চাশ হাজারের বেশি ভোটে জিতব।”
আরাবুল-কাইজারহীন ভাঙড়ে সওকাতের হাত ধরে তৃণমূল কত ভোট পায়, সেটাই এখন নানা মহলে চর্চার বিষয়।