যোগী আদিত্যনাথ। — ফাইল চিত্র।
মুজফ্ফরনগর থেকে মিরাট হাইওয়ে। মসৃণ আট লেনের হাইওয়ে ধরে ছুটতে থাকা গাড়িটা আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে রাস্তা জুড়ে গরুর পাল। গো-ব্যূহের দরজা না খোলা পর্যন্ত তাদের কাটিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নামতে হল।
রাস্তার দু’পাশে আদিগন্ত আখের ক্ষেত। উত্তরপ্রদেশের ‘সুগার বেল্ট’। প্রথম কৃষক আন্দোলনে পঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের মতো আখ চাষিরাও দলে দলে গিয়ে ডেরা বেঁধেছিলেন দিল্লি সীমান্তে। বিতর্কিত কৃষি আইনের সঙ্গে ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার আশায়। যদিও কাজের কাজ কিছু হয়নি। ফসল পেকে উঠেছে। তাই রাস্তার ধারেই আখের ক্ষেতে পেকে ওঠা চার-পাঁচটি আখ গাছকে একসঙ্গে বেঁধে দিচ্ছিলেন নৌশাদ খান।
পাছে হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টিতে আখ গাছ উপড়ে না যায়।
স্থানীয় পান্না গ্রামের বাসিন্দা নৌশাদ নজরে রেখেছিলেন গোড়া থেকেই। আলাপ গড়াতেই একটি পাকা আখ দু’টুকরো করে একটি আমায় দিলেন। অন্যটি নিজে নিলেন। গরুর পালের দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে বললেন, ‘‘এদের কারণে জানমালের লোকসান ফি দিনের ঘটনা। দিনের বেলায় খাবারের জন্য এরা খেতে হামলা চালিয়ে ফসলের ক্ষতি করে। আর রাতে রাস্তা জুড়ে বসে থাকার কারণে নিত্যদিন দুর্ঘটনা লেগেই আছে।’’
উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকার আসার পর থেকেই বেসরকারি হাতে গোমাংস বেচাকেনায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। অন্য রাজ্যের গরুর মাংসের ব্যবসা করে, এমন ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে গরু বা ষাঁড় বিক্রি বন্ধ। ফলে ফি দিন বাড়ছে ‘ছুট্টা’ পশুর সংখ্যা। নৌশাদ বললেন, ‘‘দুধ দেওয়ার বয়স পেরিয়ে গেলেই কৃষকের কাছে গরু মূল্যহীন। তাদের বসে খাওয়ানো সম্ভব নয়। কারণ, পশুখাদ্য আগে তিনশো টাকা কুইন্ট্যাল ছিল, এখন তা ১২০০ হয়েছে। অতীতে ওই গরু বিক্রি করে কিছু টাকা পেতেন কৃষকেরা। এখন সে সবই বন্ধ। তাই রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।’’
শুধু উত্তরপ্রদেশই নয়, রাজস্থান থেকে মধ্যপ্রদেশ গোটা গো-বলয়ের কৃষককুল তটস্থ ‘ছুট্টা’ পশুর উৎপাতে। সব জেনেও প্রশাসন নির্বিকার। তাই ফসল রক্ষা করতে পালা করে রাত জাগেন নৌশাদেরা। অতীতে নীল গাইয়ের কারণে ফসলের ক্ষতি হত। কিন্তু নৌশাদ বলেন, ‘‘নীল গাই তাড়ানো সহজ। ষাঁড়েরা যখন ফসলে হামলা চালায়, তাদের আটকাতে গিয়ে অনেকেই হাত-পা ভেঙে শয্যাশায়ী।’’
উল্টে আটকাতে গিয়ে যদি কোনও ষাঁড় বা গরু মারা যায় বা আহত হয় তখন আসরে নামে গোরক্ষক বাহিনীর। গত দশ বছরে উত্তরপ্রদেশের এই মুসলিম প্রধান এলাকায় হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছে গোরক্ষক বাহিনীর তাণ্ডব। সম্প্রতি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সীতাপুর জেলায় একটি খেতে গরুর মৃতদেহ পাওয়া ঘিরে সংঘর্ষ হয় এলাকায়। তাই যোগী রাজ্যে ‘ছুট্টা’ পশু সম্পর্কেও সাবধান সংখ্যালঘু সমাজ।
গোরক্ষক বাহিনী এই মুহূর্তে উত্তরপ্রদেশে এতটাই শক্তিশালী যে রাস্তায় কোন গাড়ি গরু নিয়ে যাচ্ছে, তা পুলিশের মতোই এরা নিয়মিত ভাবে নজরে রাখে। ধরা পড়লে চালকের প্রাণে বাঁচা কঠিন। তাই রাতের অন্ধকারে চুপিসারে গরু বেচে দেওয়ার যে চক্র কাজ করত, তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। নৌশাদের কথায়, ‘‘আশেপাশে মারধরের ঘটনায় দু’-তিনের প্রাণ গিয়েছে। তার পর থেকে গরু বেচা একেবারে বন্ধ। এখন আর কেউ কিনতে আসে না। বা
এলেও কেউ বিক্রি করে না। কে ঝামেলা ডেকে আনবে।’’
ফলে বৃদ্ধ গরু-ষাঁড়কে কেন্দ্র করে অতীতে গ্রামীণ এলাকায় যে অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল, যাতে সামান্য কিছু হলেও আয় হত কৃষকদের, তা একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল, কেবল রাস্তায় নয়, গোরক্ষক বাহিনীর চর ছড়িয়ে রয়েছে গ্রামে-গ্রামে। কাদের বাড়িতে ক’টা গরু বা ষাঁড় রয়েছে, তা নিয়মিত ভিত্তিতে নজরে রাখে তাঁরা। বাড়িতে পশুর সংখ্যা কমে গেলেই বাড়িতে এসে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। হিন্দুদের ছেড়ে কথা বলা হয় না। জেলার মনক্ষেরা গ্রামে বয়স্ক গরু বেচে দেওয়ার অপরাধে একঘরে করে দেওয়া হয় একটি হিন্দু পরিবারকে। বন্ধ করে দেওয়া হয় ধোপা-নাপিত। শেষে হরদৌই জেলায় হত্যাহরণ তীর্থে গিয়ে ১৫ হাজার টাকার পুজো দিয়ে ‘পাপ’ কাটিয়ে আসে ওই পরিবার। তবে ওঠে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা।
২০১৯ সালের পশু সমীক্ষা অনুযায়ী গোটা দেশে প্রায় ৫ লক্ষ ‘ছুট্টা’ পশু রয়েছে। যাদের অর্ধেক উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানে। বয়স্ক পশুর জন্য যোগী সরকার মাসে ৯০০ টাকা করে সরকারি সাহায্য দেওয়ার নীতি নিলেও, যা হাতে পান খুব সামান্য ক’জনই। মুজফ্ফরনগরের বিহর গ্রামের বাসিন্দা রাজেশ শর্মার কথায়, ‘‘এ ধরনের গরুদের জন্য সরকার গোশালা বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেখানে ছেড়ে আসতে গেলে পশু পিছু সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা চায় গোশালাগুলি। সাধারণ কৃষক এত টাকা দেবে কোথা থেকে?’’
সমস্যার সমাধানের পরিকল্পনা না করে তড়িঘড়ি গরু কেনাবেচায় নিষেধাজ্ঞা জারি করায় ক্ষুব্ধ হিন্দু-মুসলিম উভয়েই। হিন্দু সমাজ প্রথমে ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও, যে ভাবে ‘ছুট্টা’ পশুর কারণে ফি মরসুমে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন তারাও।
মানুষের ক্ষোভের কথা মাথায় রেখে লোকসভা ভোটের আগে বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে ওই রকম পশুদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল সরকারের লোকেরা। রাজেশের কথায়, ‘‘ওই পশুগুলিকে গোশালায় না দিয়ে জঙ্গলে ছেড়ে দেন কর্মীরা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। রাস্তা চিনে ফিরে আসছে। তাই দিনভর খেতে কাজ করার পরে রাতে পাহারা দেওয়া ছাড়া কোনও রাস্তা খোলা নেই আমাদের।’’