রেখা পাত্রের বাড়ি। ছবি: নবেন্দু ঘোষ।
মাত্র এক মাস। আর এই এক মাসেই অনেকখানি ভোল বদলে ফেলেছে সন্দেশখালি।
২৯ ফেব্রুয়ারি শেখ শাহজাহান গ্রেফতার হওয়ার পর সন্দেশখালিতে পা রেখে মনে হয়েছিল, মেয়েদের অধিকার ও সম্মানরক্ষার আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছে এই দ্বীপ। আর এক মাস পরে ভোটের আবহে এখানে ঢোকার পর টের পেলাম, আন্দোলনের অতীত অনেকটাই ফিকে। হাতে দা, কাটারি, লাঠি তুলে নেওয়া প্রত্যয়ী মুখগুলোর একটা অংশ অতীত দ্রুত মুছে ফেলে পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব কষতে ব্যস্ত। যাঁরা এক দিন নিজেদের সম্মান নিজেরা আদায় করতে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরা এখন প্রভাবিত হচ্ছেন, চালিত হচ্ছেন অন্যদের দ্বারা। কখনও শাসক বা বিরোধী রাজনৈতিক দল, কখনও বা বাড়ির পুরুষেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁদের। প্রভাবিত হতে হতে অনেকেই ভুলতে বসেছেন, মাত্র কিছু দিন আগেই একটা ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন তাঁরা।
নদী পেরিয়ে দ্বীপে পৌঁছলেই চোখে পড়ে চার দিকে ছোট ছোট জটলা। ভাঙাচোরা মলিন ঘর, রান্নাঘর, দাওয়া, পায়ে চলা পথ, এমনকি নড়বড়ে সাঁকো-ও সেই ফিসফিস, সেই গুঞ্জনের সাক্ষী। সন্দেশখালিতে এখন দৃশ্যতই দুটো গোষ্ঠী। রেখাপন্থী আর রেখাবিরোধী। দ্বিতীয় দফার প্রার্থী তালিকায় বড় চমক এনে সন্দেশখালির রেখা পাত্রকে বিজেপি টিকিট দেওয়ার পরে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, তা বাইরে থেকে নিভে এলেও ভিতরে ভিতরে তার ঝাঁঝ কমেনি। আন্দোলনকারী মহিলারা, এলাকার পুরুষেরা, এমনকি বিজেপি-র কর্মী মহলেও এই বিভাজন স্পষ্ট। কর্মীদের কেউ কেউ তো বলেই দিলেন “নেতাদের ভয়ে বাইরে মুখ খোলা যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের নিজেদের লোকেরাই রেখা পাত্রকে কতটা ভোট দেবে সে নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে।”
নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের এহেন অভিপ্রায়ের নেপথ্য কারণটা কী? নিজেদের প্রত্যাশামতো প্রার্থী না পাওয়া, চর্চায় থাকা নামগুলোর কোনওটাই না মেলায় নিজেরা বোকা বনে যাওয়া, নাকি একে হতদরিদ্র পরিবার, তায় আবার এক জন মহিলা, তাঁকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্তে লিঙ্গ-পরিচয়ে জ্বালা ধরা? বসিরহাট আসনের প্রার্থী বাছাইয়ে নরেন্দ্র মোদী যে অঙ্কই কষে থাকুন না কেন, সন্দেশখালিতে তা বুমেরাং হওয়ার ঝুঁকি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সন্দেশখালির মহিলা নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি-র রেখাকে প্রার্থী করার চাল-এর পাল্টা কী দেওয়া যায় তা নিয়ে তৃণমূল মাথা খুঁড়লেও রেখা-ম্যাজিকের বড়সড় কোনও লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। মাঝখানে বেশ কিছু দিন গর্তে লুকিয়ে থাকার পর প্রতিবাদী কয়েক জন মহিলাকে জড়ো করে তৃণমূল পার্টি অফিস খুলে বসলেও বিভ্রান্ত সন্দেশখালিতে কোনও কিছুই এই মুহূর্তে তেমন জোরালো প্রভাব ফেলছে না।
পাত্র পাড়ায় এক বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, রেখা টিকিট পাওয়ার পর তাঁর বাড়িতে অশান্তি বেড়েই চলেছে। তাঁর বৌমা, যিনি আন্দোলনের একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন, টিকিট না পেয়ে তাঁর মেজাজ এখন সব সময়েই তিরিক্ষি হয়ে থাকছে। ছেলেও এখন বৌমাকে প্রতিনিয়ত কথা শোনাচ্ছে। বৃদ্ধা বললেন, “আমি বলেছিলাম, প্রার্থী যেই হোক, লাভ তো আমাদের সবার হবে। মেয়েদের ওপর ওই অত্যাচারের দিন তো অন্তত আর ফিরবে না, যদি এক জন মেয়েকে জেতানো যায়। এটা শুনে বৌমা আমার গায়েহাত তুলেছিল।”
আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ নেওয়া মাঝের পাড়ার এক মহিলাকে প্রশ্ন করেছিলাম, রেখার সঙ্গে প্রচারে যাবেন? তুলে ধরবেন নিজেদের কথা? তিনি কিছু বলে ওঠার আগেই তাঁর স্বামী বললেন, “সব ক্ষীরটুকু রেখা একাই খাচ্ছে। এখন আর ওর সঙ্গে সবাই কেন যাবে?” মহিলাওমৃদু স্বরে বললেন, “দেখি। যদি ডাকে তা হলে সময় পেলে যাব এক-আধবার। আমাদের তো এখন সব দিকেই সমস্যা।”
কীসের সমস্যা? অভিযোগ, এই বিভাজনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা শুরু করেছে তৃণমূল। দেওয়া হচ্ছে নানা প্রলোভন-ও। তাতেও নাকি টলে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
রেখা পাত্রের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, দলবদ্ধ লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাকিদের অন্ধকারে রেখে তিনি একাই যাবতীয় ‘সুবিধা’ পেয়ে গেলেন। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে স্পষ্ট হয়েছে, এই অভিযোগ যত না মেয়েদের নিজের, তার চেয়ে বেশি পরিবারের পুরুষদের। বলা হচ্ছে, যতই চোস্ত হিন্দি বলুন না কেন, রেখা নিজের নামটুকুও ভাল ভাবে সই করতে পারেন না। সংসদে গিয়ে কী করবেন? অভিযোগ, প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই তাঁর হাবভাব বদলে গেছে। ভঙ্গিতে ঔদ্ধত্য এসেছে। অভিযোগ, তাঁকে পাওয়াই যাচ্ছে না। তিনি ফোন পর্যন্ত ধরেন না। একাধিক চেষ্টার পর ফোনে রেখাকে পাওয়ার পরে বোঝা গেল সতীর্থদের একাংশের এই বিরোধিতা তাঁকেও যথেষ্ট অস্বস্তিতে রেখেছে। একাধিক বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিবেদককে একটাই বাক্য বলেছেন, “আমার কিছু বলার নেই।” জনপ্রতিনিধি হওয়ার দৌড়ে নাম লিখিয়ে বলার কিছু থাকবে না? এই প্রশ্নেও নিরুত্তরই থেকেছেন রেখা।
রেখার তিন সন্তানের মধ্যে দু’জন আপাতত তাঁর দিদির কাছে। সবচেয়ে ছোটটি তাঁর সঙ্গেই থাকছে। এই শিশু কোলেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলে প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। একমাত্র তিনিই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দিও দেন। দক্ষিণ ভারতে শ্রমিকের কাজ করা তাঁর স্বামী আপাতত ফেরত এসেছেন স্ত্রী-র সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবেন বলে।
কলোনি পাড়ায় রেখার বাড়িতে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল, ভিন রাজ্যে কাজ করা তাঁর ভাসুর প্রদীপ পাত্রও ফিরে এসেছেন রেখার প্রার্থী হওয়ার খবরে। জানালেন, শাহজাহান বাহিনীর অত্যাচারেই তিনি ঘর ছেড়ে তামিলনাড়ুতে শ্রমিকের কাজ নিয়েছিলেন। এখন পরিস্থিতি বদলের আশায় ফিরে এসেছেন। জায়েরা জানালেন তাঁরা খুব খুশি। পাশাপাশি অবশ্য এও বললেন, “সবাই একসঙ্গেই আন্দোলনে ছিলাম। তার পর যে যার বরাতে যা পাওয়ার তা পেল।”
বসিরহাট লোকসভার অধীনে সাতটি বিধানসভা এলাকা। তার মধ্যে একটি সন্দেশখালি। শুধু এই একটি বিধানসভার পরিস্থিতির বিচারে বসিরহাটের ভাগ্য নির্ধারণ হবে না তা সবাই জানেন। কিন্তু যেখানে মাত্র কিছু দিন আগেও এই একটি এলাকা গোটা রাজ্যের ভোটে বড় নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল, সেখানে নানা প্রশ্ন দানা বাঁধছে।
তবে কি অত্যাচারের সেই সব রাতগুলো ভুলে যাচ্ছেন অনেকেই? না, সেটাও খুব জোর দিয়ে বলা যাবে না। আশঙ্কা মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাসের দোসর হয়ে। পুকুর পাড়ার এক আন্দোলনকারী যেমন বলছিলেন, তৃণমূল প্রার্থী জিতে এলে আন্দোলনের হিসেব যে কড়ায়গণ্ডায় চোকাতে হতে পারে, তা তাঁরা জানেন বিলক্ষণ। “শিবু-উত্তমের লোকেরা রাতের পর রাত বাইকে করে গ্রামের মেয়েদের তুলে আনত নিজেদের ডেরায়। এক জন বাইক চালাচ্ছে, আর অন্য জন বাইকের পিছনের সিটে বসে। মাঝখানে মেয়েদের বসানো হত। আশপাশের কেউ যাতে সামান্য প্রতিবাদ-ও না করতে পারে, সে জন্য রাস্তায় বলতে বলতে যেত, ‘এমন মার মারব, কোনও ব্রেক থাকবে না, না মরা পর্যন্ত।’ এ সব কি কখনও ভুলব?”
সমস্যা হল, ঘটনা পরম্পরা না ভুললেও এই অত্যাচার, যে দল-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতেও রুখে দাঁড়ানোর জেদ এবং সংকল্প আপাতত অনেকটাই চাপা পড়ে যাচ্ছে। ধামাখালির রাস্তায় এক কলেজছাত্রী বললেন, “ভোটের ফল যা-ই হোক না কেন, আমাদের অবস্থাটা সব ক্ষেত্রেই আগুন থেকে বাঁচতে ফুটন্ত তেলের কড়ায় গিয়ে পড়ার মতো হবে। এইযে দেখছেন, সবটা কেমনছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছে, এখানেই আমাদের হার। এই আন্দোলনটা রাজনৈতিক রং না পেলেই ভাল হত। আমরা একটা মডেল হতে পারতাম। তার বদলে আমরা নিজেদের মধ্যেই ভেঙেচুরে গেলাম।”
বস্তুত, নিজেদের সম্মান রক্ষার লড়াই এখন পাওনাগন্ডার হিসেবের লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্দেশখালিতে। বিভিন্ন ছাঁচে ঢেলে চলছে মেয়েদের প্রভাবিত করার চেষ্টা। কোনও রাজনৈতিক দল নয়, যেখানে আসলে জিতে যাচ্ছে পুরুষতন্ত্র। (চলবে)