ভাঙচুর হওয়া ট্র্যাক্টর। — নিজস্ব চিত্র।
জিপিএস আক্ষরিক অর্থেই গোল্লায় গিয়েছে! বিকেল গড়িয়ে ঘন অন্ধকার এবং আমরা হাঁচড়পাঁচড় করে খেতের সামনে (হেডলাইটের আলোয়) একটি সরু পথে এসে থেমেছি! ধু ধু চারপাশ। আর এমন মোক্ষম সময়ে বেআক্কেলে ঠাট্টার মতো জিপিএস দেখাচ্ছে, গন্তব্যে যেতে হলে না কি গাড়ি নিয়ে নেমে যেতে হবে ওই গমখেতের মধ্যে!
যে পথে তিন বছর আগে হাজারে হাজারে ট্র্যাক্টর, জিপ, টেম্পো, ট্রলি নিয়ে কৃষকেরা এসেছিলেন সিংঘু টিকরি গাজ়িপুরের দিল্লি সীমানায়, দুপুরে সেই পথে উল্টোপুরাণে পৌঁছেছিলাম খনৌরিতে। মুরথাল, সোনেপত, পানিপথ, কারনাল হয়ে হরিয়ানা-পঞ্জাব সীমানায় এই খনৌরি। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যেখানে প্রায় দেড় হাজার ট্র্যাক্টরের স্থায়ী সংসার। মাঝে মধ্যেই জাতীয় সড়ক বন্ধ করে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে ডান বা বাঁ দিকের গ্রামের রাস্তায়। সেই চক্করে পরে খানৌরি থেকে ফেরার সময় অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে ফের জাতীয় সড়ক ধরতে মধ্যরাত।
‘‘স্বাধীনতার পর যত নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে এটাই প্রথম, যেখানে আচরণবিধি জারি হয়ে যাওয়ার পরেও এত বড় এবং জলজ্যান্ত একটি আন্দোলন চলছে। সাধারণত যে বিষয়গুলি জরুরি নয় এমন সব কথা তুলে রাজনৈতিক দল ভোট জেতার চেষ্টা করে। যেমন হিন্দু-মুসলমানের লড়াই। কিন্তু এ বার কিসানের মুদ্দা চলবে! দেখবেন, কৃষি আন্দোলনের এই দ্বিতীয় পর্ব লোকসভা ভোটের প্রধান বিষয় হয়ে উঠছে,’’ দাবি অভিমন্যু কাহারের। হরিয়ানার ছিপছিপে এবং বুদ্ধিদীপ্ত এই যুবক এর আগে সিংঘুতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গুলে খেয়েছেন স্বাধীনতার পর বিভিন্ন কৃষক সংগ্রামের খুঁটিনাটি এবং তার আইনি মোকাবিলার দিক। নতুন তাঁবু খাটিয়ে বসে আছেন গত দু’মাস এই খানৌরিতে। কাঁকড়ির স্তূপ কেটে আপ্যায়ন করলেন। পাশের স্টোভে ডালের ফোড়ন দেওয়ার শব্দ-গন্ধ। দুপুরের খাবার দেওয়া শুরু হবে এখনই। বলছেন, ‘‘দেখুন আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের নই। কিন্তু যে রাজনৈতিক দল কৃষকের উপর জুলুম করবে, দিল্লির রাস্তা আটকে দেবে, নিষিদ্ধ তালিকার গ্যাস আমাদের উপর ছড়াবে, তাদের বিরোধিতাও করব সেই একই ভাবে। হরিয়ানার সরকার, পুলিশ, কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের আজ এই অবস্থা করেছে।’’
অভিমন্যুর বক্তব্য, ‘‘২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার দশ জন মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে কনজ়িউমার অ্যাফেয়ার্স কমিটি তৈরি করে। তার চেয়ারম্যান ছিলেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই কমিটির রিপোর্টে বড় বড় করে লেখা ছিল এমএসপি-র গ্যারান্টির কথা। আজ সেই মোদী ভাঁওতার গ্যারান্টি দিচ্ছেন।’’
মনে হচ্ছে একুশের দিল্লি সীমানায় ফিরে গিয়েছি। কৃষক আন্দোলনের হুবহু ফ্ল্যাশব্যাক যেন পঞ্জাব-হরিয়ানায়। রাস্তা জোড়া সংসার চলছে উদ্দাম রোদের নীচে। ট্র্যাক্টরের মাথায় প্লাস্টিকের চাদর অথবা তাঁবুর কাপড়। স্থানে স্থানে লঙ্গর, জলসত্র। হই হই করে পঞ্জাবি কৃষিগীতি আর লড়াইয়ের গান বাজছে মাইকে। দুই রাজ্যের অনেকাংশ থেকে আসছে সরবরাহ, রাস্তার বাধা টপকেই। তিন কিলোমিটারব্যাপী এই ধর্নাস্থলের শেষে মঞ্চ, যেখানে বক্তৃতা দিচ্ছেন কিসান মোর্চার নেতা বেনিওয়াল মোহন দল্লেওয়াল। বলছেন, ‘‘কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার আগে এই বিজেপি-ই তো কৃষকদরদি কথা বলত। কৃষিক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, পুঁজিপতিদের আটকে রাখার কথা। এটাও মোদী তখন বলেছিলেন, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এলে স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবেন। আর এঁরাই এখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ফায়দার কথা বলেন। এর আগে মনমোহন সিংহই হন বা অটলবিহারী, নরসিংহ রাও — প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রী বছরে এক বার অন্তত কৃষকদের রাজনীতি নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁদের সমস্যা-অভিযোগ শুনতেন। গত দশ বছরে নরেন্দ্র মোদী কোনও কৃষক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করেননি। অথচ তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতায় কেবল কৃষক দরদ।’’
খনৌরির হাওয়ায় উড়ছে লিফলেট আর দাবিদাওয়ার তালিকা। প্রথমত, ২০০৬ সালে দেওয়া স্বামীনাথন কমিশনের কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) সংক্রান্ত প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। যেমন কুইন্টাল প্রতি গম এখন দু’হাজার টাকায় কেনে সরকার। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী তাকে অন্তত চার হাজার টাকা করতে হবে। দুই, ৩৩টি শস্য সরকারের কেনার প্রশ্নে আইনি গ্যারান্টি চাই। গত দু’মাসে চণ্ডীগড়ে পীযূষ গয়াল, অর্জুন মুন্ডা এবং সরকারি আধিকারিকরা চার বার কৃষক মোর্চার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কোনও আশ্বাস তাঁরা দেননি। তিন, কৃষকদের ঋণ বেড়েছে সরকারের ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে। প্রস্তাবিত এমএসপি যদি পাওয়া যেত, তা হলে কৃষকদের এত দিনে ৪৫ লক্ষ কোটি টাকা বাড়তি পাওয়ার কথা। উল্টে তাদের ঋণের বোঝা দাঁড়িয়েছে ১২ লক্ষ কোটি টাকায়। বাড়তি টাকা না দিক, এই ঋণটুকু অন্তত মকুব করুক সরকার। চার, কৃষিক্ষেত্রকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতার বাইরে আনা। কৃষিক্ষেত্রকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বাইরে রাখা। পাঁচ, পরিবেশ সংক্রান্ত আইনকে কৃষিক্ষেত্রের বাইরে রাখা। ছয়, লখিমপুর খেরির হত্যায় অভিযুক্তেরা খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। সাত, কৃষিক্ষেত্রে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ। আট, কৃষি জমি অধিগ্রহণের নতুন আইনে কৃষকদের
সম্মতি বাধ্যতামূলক নয়। তাকে বাধ্যতামূলক করা।
হরিয়ানার পুলিশ এই আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা করে এখন রণে স্থগিত দিয়েছে। কারণ, সামনেই নির্বাচন। কিন্তু পুলিশের লাঠিতে ভাঙা ট্র্যাক্টর আলাদা করে সাজিয়ে রেখেছেন এখানকার আন্দোলনরত কৃষকেরা, ঘুরিয়ে দেখালেন সে সব। যাতায়াতের পথে মাঝে মধ্যেই পেরেক ফেলে রাখা হচ্ছে। শুধু খনৌরি নয়, জাতীয় সড়কে শম্ভু, ফতোয়াবাদের মতো বেশ কিছু জায়গায় চলছে আন্দোলন।
কৃষক আন্দোলনের এই বজ্রনির্ঘোষ উত্তর ভারতে পঞ্জাব-হরিয়ানার বাইরে ভোটব্যাঙ্কে কতটা ছায়াপাত করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু মাত্র সন্দেহ নেই যে ২০২৪-এ নতুন সরকার গঠন হলেও, কৃষকেরা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ট্র্যাক্টরের সংসার গোটাবেন না। এখানে না হোক, অন্য কোনওখানে। (চলবে)