আলাপ্পুঝায় প্রচারে বেণুগোপাল (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
জল, জল আর জল! ‘ব্যাক ওয়াটারে’ ঘেরা কেন্দ্রে ইতিউতি দৌড়চ্ছে প্রচার-গাড়ি। দক্ষিণ ভারতের মানুষ গর্ব করে জায়গাটাকে বলেন ‘প্রাচ্যের ভেনিস’। এই ভেনিসে এ বার যেন জলেই পড়েছেন কে সি বেণুগোপাল!
পাঁচ বছর আগে কেরলে রাহুল গান্ধী-হাওয়ায় যখন রাজ্যের ২০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৯টিতেই জিতেছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ, সেই সময়ে একমাত্র আলাপ্পুঝা গিয়েছিল সিপিএমের দখলে। সেই আলাপ্পুঝাতেই এ বার ফের প্রার্থী হয়েছেন সবর্ভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বেণুগোপাল। এখান থেকেই ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১০ বছর লোকসভার সাংসদ ছিলেন। কিন্তু এ বারের লড়াই সম্পূর্ণ অন্য মাত্রার। কে সি (রাজনৈতিক জগতে এই নামেই বেণুগোপাল পরিচিত) জিতলে বিড়ম্বনা, হারলেও তা-ই!
কে সি এখন রাজস্থান থেকে রাজ্যসভার সাংসদ। তাঁর মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত। আলাপ্পুঝার সিপিএম সাংসদ এবং প্রার্থী এ এম আরিফ তাই বলছেন, ‘‘কংগ্রেস প্রার্থী যদি এখানে জেতেন, তাঁকে রাজ্যসভার আসন ছাড়তে হবে। রাজস্থান বিধানসভার এখন যা বিন্যাস, একটা আসনে উপনির্বাচন হলে বিজেপি সেটা পেয়ে যাবে। কংগ্রেস প্রার্থী তার মানে এখানে জিতে বিজেপিকে অন্য দিকে সাহায্য করতে চান!’’ সিপিএমের এই প্রচারের জুতসই জবাব কংগ্রেসের কাছে নেই।
কালিকট বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে এমএসসি করা কে সি কোন অঙ্ক কষে আলাপ্পুঝায় প্রার্থী হতে গেলেন, তা নিয়েই এ বার বিস্তর চর্চা। তিনি এখন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতা তো বটেই, দলে রাহুলের ডান হাত, ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের কমিটির সদস্য হিসেবে বিজেপি-বিরোধী অন্যান্য দলের সঙ্গে সমন্বয়েরও দায়িত্বে। যার মধ্যে সিপিএম-ও আছে! যে কারণে বাম নেতারা বলছেন, অন্য কাউকে আলাপ্পুঝায় দাঁড় করালেই কংগ্রেস বিচক্ষণতার পরিচয় দিত। কে সি অবশ্য দাবি করেন, ‘‘আমি আগে এখানে বিধায়ক ছিলাম, সাংসদ ছিলাম। এই এলাকার সঙ্গে অনেক দিনের পুরনো যোগাযোগ। এখানকার কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা চেয়েছেন বলেই প্রার্থী হয়েছি। তাঁদের দাবি ফেলা যায়নি।’’
এই যুক্তিতে রাজনৈতিক বিতর্ক অবশ্য থামছে না। কেরলের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এবং পাতানামতিট্টা লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী টমাস আইজ়্যাক যেমন বলছেন, ‘‘রাহুল গান্ধী, কে সি বেণুগোপালেরা সর্বভারতীয় নেতার বেদি থেকে নেমে এখানে এসে পাঁকে ঢুকে পড়েন! রাজ্যের বাম-শাসিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতার দাবি করেন কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে। অরবিন্দ কেজরীওয়ালের ক্ষেত্রেও সেই দাবি করেছিলেন, আবার তাঁর গ্রেফতারের পরে প্রতিবাদেও শামিল হয়েছেন!’’
রাহুলের কেন্দ্র ওয়েনাড় এড়িয়ে গেলেও কে সি-র আসনে দলের প্রচার বাদ দেননি সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তাঁরও বক্তব্য, ‘‘এই নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীকে পরাস্ত করা এবং বিজেপিকে ফের সরকার গড়তে না দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। কংগ্রেস তা-ই চায় না কি মোদী যাতে কেরলের মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করেন, সেটা তাদের প্রধান লক্ষ্য? আত্মসমীক্ষা করা উচিত!’’
আলাপ্পুঝার বিজেপি প্রার্থী শোভা সুরেন্দ্রন মওকা পেয়ে বলছেন, ‘‘দিল্লিতে যাঁরা দোস্তি করছেন, তাঁরাই কেরলে এসে মুখোমুখি কুস্তি করছেন! এই দ্বিচারিতার খেলা মানুষ ধরে ফেলেছেন।’’ কংগ্রেস এবং সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য মনে করেন, রাজ্য স্তরে তাঁদের মধ্যে লড়াইয়ের কারণেই কেরলের রাজনৈতিক পরিসরে বিজেপি জমিয়ে বসতে পারছে না। তবে তা সত্ত্বেও কে সি-র প্রার্থী হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থামছে না।
আলাপ্পুঝায় প্রচার ছেড়েই এর মধ্যে কয়েক বার দিল্লি দৌড়তে হয়েছে কে সি-কে। প্রচারের মধ্যেও এআইসিসি এবং নানা রাজ্য থেকে আসা সাংগঠনিক প্রয়োজনের ফোন তাঁকে এগিয়ে দেন সঙ্গীরা। প্রচার-সভায় কেন্দ্রের বিজেপি এবং রাজ্যের সিপিএমের বিরুদ্ধে তোপ দেগে চলেন তিনি। কংগ্রেসের অন্দরে নেতারা বলেন, কেরলে নিজের ‘দায়ে’র জন্য বাংলায় বামেদের সঙ্গে সমঝোতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বাধ সেধেছেন কে সি-ই। অথচ কেরলের
পাশে তামিলনাড়ুতে ডিএমকে, কংগ্রেস এবং সিপিএম-সিপিআই জোট বেঁধেই লড়ছে!
অঙ্কের এমন গোঁজামিলের আবহে তিনি অর্থাৎ কে সি নিজের জন্য লক্ষ্য বেঁধেছেন, ‘‘২৬ তারিখ (কেরলে ভোট) চলে গেলে আমি আবার সর্বভারতীয় দায়িত্বে!’’