Lok Sabha Election 2024

লাভ কী হল, প্রশ্ন পণ্ডিত নেতার

এক যুবক আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন বহু প্রাচীন কাঠের বাড়িটিতে, যেখানে ঠান্ডার মধ্যেও মাটিতে কম্বল বিছিয়ে বসে রয়েছেন সঞ্জয় টিক্কু, গরম জলের ফ্লাস্ক হাতে।

Advertisement

অগ্নি রায়

শ্রীনগর শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪ ০৭:১৭
Share:

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। বুঝতে পারছি, পথপ্রদর্শক যদি আবার ফিরিয়ে না আনেন বড় রাস্তায়, আমি কোন ছাড়, ফেলু মিত্তিরও ফেল মেরে যাবেন এর গোলকধাঁধায়! যে শহরে হুরিয়ত নেতারা সবাই জেলবন্দি, তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও আঁতকে উঠছেন মহল্লাবাসী, যেখানে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বেশির ভাগই ভুলেও ঘরে ফেরার কথা ভাবেন না, সেখানে এমন রাস্তা দিয়েই যে কাশ্মীরি পণ্ডিত সংঘর্ষ সমিতির প্রতিষ্ঠাতার আস্তানায় ঢুকতে হবে, সেটাই তো দস্তুর। ঠিক আন্ডারগ্রাউন্ড না হলেও, শ্রীনগরের বরবর শাহ এলাকার ঘিঞ্জি অলিগলির ভিতর কারও বিশেষ দৃষ্টি না টেনে, কোনও মতে সেঁধিয়ে থাকার এই
তো দস্তুর।

Advertisement

এক যুবক আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন বহু প্রাচীন কাঠের বাড়িটিতে, যেখানে ঠান্ডার মধ্যেও মাটিতে কম্বল বিছিয়ে বসে রয়েছেন সঞ্জয় টিক্কু, গরম জলের ফ্লাস্ক হাতে। প্রাণের ভয়, বারবার হামলা সত্ত্বেও যিনি জমি না ছেড়ে গড়ে তুলেছেন নিজের সম্প্রদায়ের এই সংঘর্ষ সমিতি। “যে গলি দিয়ে আপনি এলেন, সেখান দিয়েই জেকেএলএফ-এর লোকেরা এসেছিল দু-দু’বার আমাদের নিকেশ করতে। পারেনি, বরাত জোরে বেঁচে যাই পালিয়ে গিয়ে। ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ মোদীর রাজত্বে বর্ণহিন্দু এই সম্প্রদায়ের এখনও ত্রাসবন্দি অবস্থা। এই যেমন আমাদের দেখছেন, গোটা শ্রীনগরের ২৬২টি আস্তানায় ৮০৮টি কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবার কোনও মতে টিকে রয়েছি এখনও। মোট সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। দশ বছর আগে বিজেপি প্রথম ক্ষমতায় আসার আগে তাদের ইস্তাহরে আমাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি দাগিয়ে রেখেছিল। কিন্তু গ্রাউন্ড জিরোতে কিস্যু করেনি তারপর।’’ অভিযোগ জানাচ্ছেন টিক্কু।

টিক্কুর কথায়, শেষ যা নড়াচড়া হয়েছিল তা মনমোহন সরকারের সময়, ২০০৮ সালে। নব্বইয়ের উপত্যকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া পণ্ডিতদের জন্য ৬ হাজার চাকরির একটি পুনর্বাসন প্যাকেজ দেওয়া হয়। যাঁরা উপত্যকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তাঁদের জন্যই। এখনও পর্যন্ত ওই পরিকল্পনায় ২৭০০ জন চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর আর ফেরত পাননি, যা ছেড়ে গিয়েছিলেন ’৯০ সালে। শেখপুরা, পুলওয়ামা, বড়গাঁও-এর মতো সাতটি জায়গায় অস্থায়ী তাঁবুতে জীবন কাটাচ্ছেন। কয়েক জন বাড়ি পেয়েছেন, কিন্তু সেটা ছেড়ে যাওয়া বাড়ির তুল্যমূল্য নয়, এক কামরায় মাথা গোঁজার আস্তানা মাত্র। পরিবার নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাঁর আক্ষেপ, “কিন্তু আমরা যারা থেকে গিয়েছিলাম, সেই সময়ের প্রাণনাশের হুমকি ও আতঙ্কের সঙ্গে লড়াই করে, তাদের জন্য কোথাও কোনও শিকে ছেঁড়েনি আজও।”

Advertisement

লোকসভা ভোট হওয়া, বিধানসভা নির্বাচন না হওয়া বা গণতন্ত্রের উৎসবে যোগ দেওয়ার মতো বিষয়গুলি অনেক দূরের বাতিঘর, শ্রীনগরের (এবং তার বাইরেরও) পণ্ডিতদের কাছে। কারণ, তাঁদের সামান্য চলাফেরা বাজারহাট কাজকর্ম করার উপরে নজর রাখে প্রশাসন এবং ‘নন স্টেট অ্যাক্টর’রা। প্রতিনিয়ত। টিক্কুর কথায়, “২০২১ এর অক্টোবর থেকে আমি নিজের ইচ্ছামতো, প্রশাসনকে না জানিয়ে কোথাও যেতে পারি না। সম্প্রতি সমস্ত থানা থেকে যে যার এলাকার পণ্ডিতদের নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়েছে। লোকসভা ভোট আসছে। বলা হয়েছে, আমরা ভোরে বা বেশি রাতের দিকে যেন বাইরে না যাই। গেলে প্রশাসনকে জানাতে হবে। সঙ্গে সব সময় লোক থাকছে। একে কী বলবেন আপনারা? কাশ্মীরে স্বাভাবিকতা ফিরেছে? না, ভোট চাইতে, কোনও দলই নব্বইয়ের পর আমাদের কাছে আসেনি। আমরা ফাউ-এর মতো ঝুলে রয়েছি এই উপত্যকায়।”

অল্প আলোয়, প্রৌঢ় হয়ে যাওয়া চেহারাটা যেন কিছুটা হতোদ্যমই। পণ্ডিতদের উপরে হামলার পর আট বছর দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে ’৯৮ সালে এই সংঘর্ষ কমিটি তৈরি করেছিলেন ওঁরা। প্রতিটি গ্রামে গিয়ে পণ্ডিতদের হাল হকিকত নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দু’বার বৈঠকে বসেন টিক্কু প্রতিনিধিদল নিয়ে। জানালেন, “মোদী শোনেন সব, কিন্তু বলেন না কিছুই। আমরা খুবই ঝাঁঝালো ভাষায় বলে এসেছিলাম, আমাদের হাতে অস্ত্র নিতে বাধ্য করবেন না। দেবগৌড়া থেকে আজ পর্যন্ত সব প্রধানমন্ত্রীকেই স্মারকলিপি দিয়েছি আমরা। এক আধ বার বাদে সেগুলি নিশ্চয়ই আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা হয়েছে।”

নব্বইয়ের আগে কাশ্মীরে ছিলেন পণ্ডিতদের ৭৫,১২৪টি পরিবারের মোট সওয়া তিন লাখ সদস্য। আজ সর্বার্থে তাঁরা হতশ্রী। শ্রীনগরের পণ্ডিতদের মতামতের নির্যাস— দু’টো কারণে বিজেপি তাঁদের কার্যত অচ্ছুৎ করে রেখেছে। প্রথমত, কাশ্মীরের রাষ্ট্র সমর্থিত এবং বহিরাগত হিংসার সামনে সব সময় বোড়ের মতো ব্যবহার করেছে নয়াদিল্লি পণ্ডিতদের। দ্বিতীয়ত, আরএসএস এবং বিজেপি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপরে প্রতিশোধের রাজনীতি চালিয়েই যাচ্ছে পণ্ডিত নেহরুর কারণে।

যাঁরা বাইরে প্রতিষ্ঠিত, সেই সব পণ্ডিতেরা আর ভুলেও ফিরতে চান না ভূস্বর্গে। এখানে চাকরি নেই, সুযোগ নেই, স্বাধীনতা নেই, প্রাণের ভয় রয়েছে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া ৭৫ হাজার পরিবারের অন্তত তিরিশ শতাংশ এখনও চান গ্রামে ফিরে আসতে, যেখানে তাঁদের জমিজমা রয়ে গিয়েছে কিছু।

আমাকে এগিয়ে দিতে নীচে নামলেন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের আন্দোলনের এই পুরোধা। পাথরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে হাত মেলালেন। উপত্যকার ভোট মানচিত্রের থেকে যেন অনেকটাই দুরে দাঁড়িয়ে। বললেন, “ক্ষমতায় আসার আগে তো বিজেপি নিয়মিত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিষয়টি তুলত সংসদে। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই। ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত হওয়ার পরেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলেছিল, প্রত্যেকটি কাশ্মীরি পণ্ডিতকে পুর্নবাসন দেওয়া হবে। দিল্লিতে গিয়ে খোঁজ করবেন তো, আজও কেন কোনও নতুন টাউনশিপ তৈরি করা হল না? রাজনাথ সিংহের তবুওএকটা দরদী মন ছিল। অমিত শাহ আসার পর আমাদের উপর আরও নির্মম হয়েছে সরকার।” তাঁর দাবি, ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পরে তাঁদের জন্য পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। তাঁদের হিন্দু পরিচয়কে সামনে রেখে উপত্যকার সংখ্যালঘু মানুষেরা বিজেপি-র উপর ঝাল মেটাচ্ছেন। এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে— যা হচ্ছে তার জন্য পণ্ডিতরাই দায়ী। "৩৭০ তোলার আগে আমরা চেষ্টা করছিলাম নাগরিক সমাজ তৈরি করে জঙ্গি মৌলবাদী এবং আমাদের মধ্যে একটা দেওয়াল তৈরি করতে। হুরিয়তও সঙ্গে ছিল এই প্রয়াসে। এখন আর সে সবও নেই।"

আবার সেই সরু গলির পর গলি পেরিয়ে যখন বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম, অন্ধকার নেমে এসেছে লোকসভা ভোটের মুখে দাঁড়ানো কাশ্মীরে।

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement