—প্রতীকী ছবি।
পসরা বোঝাই ছোট নৌকাটি এসে আমার মখমল সজ্জিত শিকারার পাশের তক্তায় মৃদু ধাক্কা মারল। এখানকার জলবাণিজ্যের রেওয়াজ মাফিক। ঠোকাঠুকিতে যে শব্দ তৈরি হল তাকে শোনাচ্ছে এক বিষণ্ণ চিয়ার্স-এর মতো।
বিষণ্ণ কেন? এই তো বেশ গোধূলির মুখে নানাবিধ আলো জ্বলে উঠছে ডাল লেক চত্বরে। স্মার্ট সিটি-র আওতায় আসা শ্রীনগরে খামচা খামচা করে উন্নয়নের রুজ় পমেটম। লাল চৌকে বিভিন্ন বহুজাতিক ব্র্যান্ডের গ্লোসাইন বিজ্ঞাপনে স্বপ্নসুন্দর পুরুষ ও নারীরা। ক্লক টাওয়ারে তিরঙ্গা আলো। পর্যটকরা সুদূরের রুপোমাথা পাহাড়কে ফ্রেমে রেখে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। উনিশের লোকসভা ভোটের আগে এসে যে হাউস বোটগুলিকে নিথর ও ভুতুড়ে দেখেছিলাম, আজ তার রেলিংয়ে দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গের ভেজা জামাকাপড় শুকোচ্ছে।
চিনার গাছ ঘেরা ডাল লেকের গভীরে, কথায় কথায়। আশপাশ থেকে ছোট নৌকা আখরোট, কেশর, রঙিন পাথরখচিত গয়নার পসরা সাজিয়ে। বাদামের গুঁড়ো, এলাচ আর কেশর দিয়ে বানানো এখানকার জনপ্রিয় কাওয়া চা-এর কেটলি-বাহিত নৌকা, ম্যাগির ভাসমান দোকান, কাঠকয়লার উনুনে কাবাবের লোভনীয় সম্ভার নিয়ে। এ রকমই এক নৌকা-ব্যবসায়ী রাহিল মির্জা। “৩৭০ তোলার সময়ে সেনা দিয়ে আমাদের জীবন বিষ করে দিয়েছিল। সর্বক্ষণ পাহারা, ঘর থেকে বেরিয়ে কাম ধান্দা করতে পারিনি কত দিন। আর আজ, বাজারে এমনই আগুন, পর্যটক এলেও আমাদের পকেট ফুটোই।”
কাশ্মীরের সমস্যা তবে দেশের মূলস্রোতে ঢুকে এল? দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান বা তামিলনাড়ু—মূল্যবৃদ্ধি তার আঁচড় কাটেনি কোথায়ই বা? রাহিল যেমন বলছেন, “চার বছর আগেও হাজার টাকার মধ্যে বিজলির বিল আসত আমাদের হাউস বোটগুলোতে। এখন এলজি-র জমানায় স্মার্ট মিটার লাগিয়েছে। বিল আসছে পাঁচ থেকে ছ’হাজার, কখনও আরও বেশি। আগে একটা শিকারা বানাতে যা খরচ হত, এখন তার চার গুণ। অথচ কোভিডের পরে পর্যটকেরাও হাত উল্টে দিচ্ছেন। আমরা বেশি পয়সা চাইলেই তাঁদের সঙ্গে ঝুটঝামেলা। দিল্লিতে যাদের সরকার, এখানেও দশ বছর ধরে তাদেরই। আমাদের কথা আর কে শোনে বলুন?”
সূর্য, ডাল লেকের সঙ্গে শেষ দেখাশোনা সেরে, ক্রমশ পাটে। ঠান্ডাও যেন বেড়ে গেল আরও। রাহিল শিকারার এক নম্বর ঘাটে নোঙর করে বিড়ি ধরানোর তোড়জোড়ে। শিকারা সমবায়ের এই মন, কাশ্মীরের সংখ্যাগুরু মনেরই প্রকাশ, কিন্তু তা খণ্ডচিত্রও বটে। অন্তত পাঁচ বছর আগের সঙ্গে তুলনায় সেটাই মনে হয়। উনিশে এবং তার আগে বার বার এই ভূস্বর্গে এসে যে সর্বগ্রাসী আতঙ্কের ছাপ দেখেছিলাম, তা এবারে অনেকটাই যেন স্তিমিত। পুলওয়ামা পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসবাদী কোনও বড় হামলা নেই, রাস্তাঘাটে পাথর ছুড়ছে না কেউ, ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে টোল প়ড়েনি। হরতাল একেবারেই বন্ধ।
টিউলিপের দিন শুরু হচ্ছে, ন্যাড়ামাথা চিনারে সবুজ ধরবে আর এক মাসের মধ্যেই। সঙ্গে আসছে লোকসভা ভোট, যা নিয়ে কাশ্মীরের মনে অনেক সন্দেহ আর কূটচিন্তা। শিকারা ঘাটের আড্ডায় কাসেম আলি বলছেন, “কাশ্মীরের দুঃখ কেউ শুনতে চায় না। আমাদের ভোট হয় না, দশ বছর হয়ে গেল। সরকারি বাবুরা চালাচ্ছেন, কোনও দায় দফায় তাদের আমরা পাবই বা কোথায়, আর তারা আমাদের জন্য কিছু করবেনই বা কেন? তবে ভোট এ বার আমরা দেব। দেখবেন কাশ্মীরের তিন সিটে ভোটের জন্য দীর্ঘ লাইন পড়বে। কারণ, আমাদের হাতে দীর্ঘ দিন পর এই একটাই সুযোগ এসেছে নিজেদের মতামত জানানোর, সেটা ছাড়বেনা কেউই।”
কাসেমের ক্ষোভের কারণ রয়েছে। ২০১৮ সালের পর এখানে পঞ্চায়েত ভোট হয়নি, ১৪-র পর থেকে বিধানসভা ভোটের নাম গন্ধ নেই। এক দিকে এখানকার তিনশো সত্তর বিলোপ পরবর্তী আইনশৃঙ্খলার বিজ্ঞাপনে দেশ জুড়ে প্রচার করছে মোদী সরকার। অন্য দিকে, বিধানসভা ভোটের নামে নিরাপত্তার চিন্তা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং স্থানীয় একটি ভাবনা-কেন্দ্রের পরিচালক মীর আহসন আফরোজের কথায়, “এখানে শেষ নির্বাচন হয়েছে জেলা পর্যায়ে ডিডিসি-র তাও চার বছর হতে চলল। ফারুক আবদুল্লার নেতৃত্বে সাত দলের জোট (কংগ্রেস, সিপিএম, পিডিপি-সহ, নাম পিএজিডি) তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জিতেছে। খেয়াল রাখতে হবে বিজেপি-ও তাতে মোট ২৭৮টি আসনের মধ্যে ৭৫টিতে জিতেছে। এই পিএজিডি জোটের কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই, যে টুকু আছে তা হল এলজি-র কথামতো প্রশাসনিক কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার, নিজস্ব পকেটে।’’ তাঁর আরও ব্যাখ্যা, ‘‘উপত্যকায় যে ভাবেই হোক বিজেপি পায়ের ছাপ রাখছে। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক ক্ষমতার দিক থেকে ৩৭০-এর পর কাশ্মীরবাসীর মধ্যে গভীর বিচ্ছিন্নতার বোধ তৈরি হচ্ছে। বাইরের তৈরি করা পালিশে চোখ সইয়ে নিলেই তা চোখে পড়তে বাধ্য।”
শিকারা ঘাটের বিড়িচক্র থেকে উঠে আসার সময় ছুঁড়ে দেওয়া বাক্যটি মনে পড়ে গেল। ‘কাশ্মীর থম মেরে রয়েছে। যে দিন ফেটে বেরোবে, দিল্লির ঘুম ছুটে যাবে!’ (চলবে)