—প্রতীকী ছবি।
আর ‘ডি’ নন বর্মণরা!
এই প্রথম ভোট দেবেন। নাহ্, ওঁদের কেউ আর আঠারোর নন। কেউ আটান্ন, কেউ আটষট্টি! কিন্তু জীবনে প্রথম ভোটদানের উচ্ছ্বাস, এত দিনের সরকারি গাফিলতির ক্ষতে খানিকটা হলেও মলম লাগাতে চলেছে।
১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে আসেন বহু মানুষ। তাঁদের কাউকে বামনি, কাউকে মাটিয়া, কাউকে গোয়ালপাড়ায় আশ্রয় দিয়েছিল তদানীন্তন সরকার। তাঁদের মধ্যে বাঙালি যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন বাংলাভাষী হাজোংরা। ছিলেন বাংলাদেশের গারোরাও। বাঙালিদের বড় একটি দলকে গুয়াহাটির বোন্ডা এলাকায় পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। দেওয়া হয় জমির কাগজও। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁদেরই অনেকের নামে আসে ডি-ভোটারের নোটিস। তারপর থেকে, অসম পুলিশের সীমান্ত শাখা, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল ও নির্বাচন কমিশনের গাফিলতি, দীর্ঘসূত্রতার মাসুল গুনে চলেছেন তাঁরা।
১৮ বছর হতেই ভারতের ভোটার তালিকায় নাম তুলেছিলেন মিনতি বর্মণ। কিন্তু প্রথম বার ভোট দেওয়ার আগেই ১৯৯৮ সালে তাঁর নামে ডি-ভোটারের নোটিস হাজির। আর ভোট দেওয়া হয়নি। অথচ মিনতির বিরুদ্ধে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে মামলা শুরু হয় ২০১১ সালে, অর্থাৎ ডি ভোটারের নোটিস পাঠানোর ১৩ বছর পরে। তিন বছর মামলা চলার পরে জিতেও যান মিনতি। ২০১৪ সালে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তাঁকে ভারতীয় হিসেবে ঘোষণা তো করল, কিন্তু সেই তথ্য এসে পৌঁছল না নির্বাচন কমিশনের দফতরে। তাঁর মতোই, বোন্দা এলাকার দুলালি বর্মণ, মঞ্জু বর্মণ, গৌরাঙ্গ বর্মণ, মিলন বর্মণরাও দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে সম্প্রতি তাঁদের ভোটাধিকার ফিরে পেয়েছেন।
এলাকার বাসিন্দা গোপাল ভট্টাচার্য জানান, ১৯৬৪ সালে অসমে আসার পরে যখন সরকার তাঁদের পুনর্বাসন দিয়েছিল, তখনই জমির অ্যালটমেন্ট পেপারও দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৯৮-৯৯ সাল নাগাদ বাঙালিদের অনেকের নামেই ডি-ভোটার নোটিস পাঠাতে শুরু করে সীমান্ত শাখার পুলিশ। তাঁদের অনেকেই গরিব, স্বল্প শিক্ষিত। তাই ওই নোটিসের গেরো বুঝতেই তাঁদের বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। চলে আসে এনআরসি পর্ব। স্বাভাবিক ভাবেই নামের আগে ‘ডি’ বা সন্দেহভাজন ভোটারের তকমা থাকায় ওঁদের কারও নাম ওঠেনি এনআরসিতে। পাননি আধার কার্ড, রেশন কার্ড, সরকারি সুবিধা।
গোপাল যোগাযোগ করেন বিনামূল্যে আইনি সাহায্য প্রদান করা সংস্থা ও আইনজীবীদের সঙ্গে। তেমনই এক আইনজীবী দেবস্মিতা ঘোষ দীর্ঘদিন ধরেই নাগরিকত্ব সংক্রান্ত মামলা লড়ছেন। তিনি জানান, বোন্দার মিনতি, দুলালি, মঞ্জু-সহ ডি-ভোটারের দাগ লাগা সিংহভাগের মামলাই তিনি চালিয়েছেন। ফরেনার্স ট্রাইবুনালে তাঁরা ভারতীয় হিসেবে প্রমাণিতও হয়েছেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে রায় বেরোলেও সেই রায়ের বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসন নির্বাচন কমিশনে জানায়নি। ফলে মামলা জিতেও সন্দেহভাজন ভোটারই থেকে গিয়েছেন তাঁরা। বিস্তর দৌড়ঝাঁপের পরে এত দিনে মিনতিদেবী, মঞ্জুদেবী, দুলালিদেবীদের নামের সামনে থেকে সরেছে ডি। তবে ভোটার পরিচয়পত্র এখনও পাননি তাঁরা। কিন্তু আশ্বস্ত করা হয়েছে, আধার বা নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত অন্যান্য পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ভোট দিতে পারবেন।
এই ৫৫ বছরে এসে ৭ মে বোন্দার নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ভোটার হিসেবে নাম ওঠায় অষ্টাদশী তরুণীর মতোই খুশি মিনতি। বলেন, “নামের সামনে থেকে যে দিন ‘ডি’ সরে গেল, সেই আনন্দ বোঝাতে পারব না। সেই ১৮ বছরে যে আনন্দ নিয়ে ভোটার তালিকায় নাম তুলেছিলাম, সেই আনন্দের রেশ নিয়েই ৫৫ বছরে প্রথম বার ভোটের লাইনে দাঁড়াব।”
অবশ্য তাঁর মতো কপাল এলাকার সকলের নয়। কারণ, রামমোহন বর্মণ, আরতি বর্মণ, পাখি বর্মণ, পুষ্পা বর্মণ, কামনা দাস, বিমলা বর্মণ, সাধনারানি বর্মণরা এ বারেও ভোট দিতে পারছেন না। সকলেই মামলা জিতে ভারতীয় হয়েছেন বটে, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের তরফে ডি-মুক্ত এখনও হতে পারেননি।