—প্রতীকী ছবি।
‘‘বড় ফুল, ছোটো ফুল কেউ এখানে আসে নাই। বড় ফুল সরোবরে ফুটে থাকে বটে। লাগাল পাই না। ছোট ফুলই বা কোথায় দেখা মেলে? তবে ভোট দিব। কিন্তু কাকে ভোট দিব, এখনই বলবনি।’’
ঝালদা থেকে ঘণ্টাখানেক দূরে অযোধ্যা পাহাড় ঘেরা জঙ্গলের মধ্যে বাঘবিন্ধ্যায় তখন সন্ধ্যা নামছে। গ্রামের বাসিন্দা লম্বোদর সিংহের এক কথা, “ভোট কাকে দিব, বলবনি।” এই কথাটা যেন সারা পুরুলিয়া জুড়েই বাজছে। আর তাই স্বস্তিতে নেই কোনও দলই।
পুরুলিয়ায় এ বার লোকসভা ভোট চতুর্মুখী। তৃণমূল, বিজেপি বাদেও আসরে নেমেছে সিপিএম-কংগ্রেসের জোট এবং কুড়মি সমাজ। পুরুলিয়ার সাধারণ মানুষের কথায়, জোট বা কুড়মি সমাজ জিততে পারবে কি না, প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ভোট কাটাকাটির খেলায় অন্যের যাত্রাভঙ্গ করে দিতেই পারে তারা।
গত বার লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো জিতেছিলেন দু’লাখেরও বেশি ব্যবধানে। সেই ব্যবধান কি এ বার আদৌ থাকবে? পুরুলিয়া শহরে ঢোকার কিছুটা আগে হুটমুড়া গ্রামের চায়ের দোকানের জটলায় এই প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন পলাশ মাহাতো। পলাশ বলেন, “এর আগে কোনও বার কুড়মি সমাজের নিজস্ব প্রতিনিধি ভোটে দাঁড়াননি। এ বার বালতি চিহ্ন নিয়ে অজিত মাহাতো দাঁড়িয়েছেন। গত বার কুড়মি সমাজের দেড় লাখের উপর ভোট প্রায় পুরোটাই পেয়েছিল বিজেপি। সেই ভোট কি পুরোটাই এ বারও বিজেপি পাবে?”
পুরুলিয়া শহর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা দূরে কুড়মি প্রধান গ্রাম গোকুলনগর। পুকুর পারে বসে তাস খেলছিলেন কয়েক জন। তাঁদেরই এক জন, দীপক মাহাতো বলেন, “এ বার তুরুপের তাস আমাদের হাতে। আমাদের প্রধান দাবি, ওবিসি থেকে এসটি করতে হবে। এই দাবি নিয়ে কোনও দল দিল্লিতে দরবার করেনি। এ বার নিজের দলের লোককে ভোট দিয়ে দেখি।” কিন্তু গোকুলনগরের দেওয়ালে বালতি চিহ্ন কোথায়? সেখানে তো পদ্ম আর ঘাসফুল। দীপক হেসে বলে, “দেওয়াল দেখে বোঝা যাবে না।’’
শুধু কুড়মি ভোট নয়, পুরুলিয়ায় পিচে শেন ওয়ার্নের মতো বল ঘোরাতে পারেন কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতোও। পুরুলিয়া শহরের বাসস্ট্যান্ডের কাছে কয়েক জন কংগ্রেস সমর্থক স্বীকার করে নিলেন, “গত লোকসভায় পুরুলিয়ার বেশিরভাগ বাম ভোট রামে গিয়েছিল। কংগ্রেসের অধিকাংশ ভোটও তা-ই। এ বার যাবে না। ফরোয়ার্ড ব্লক আলাদা লড়লেও ওদের ভোট বেশি নেই।’’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও পুরুলিয়ার জনসভায় এসে নেপালের উদ্দেশে প্রশ্ন তুলেছেন, “আপনি কার ভোট কাটতে ময়দানে নেমেছেন?” নেপাল নিজের কার্যালয়ে বসে বলেন, “তার মানে কি আমাদের ভোটের উপর শুভেন্দুদের জেতা-হারা নির্ভর করছে? বাম-কংগ্রেসের ভোট তো পাচ্ছিই, কুড়মি ভোটও পাব। সংখ্যালঘু ভোট আমাদের দিকে। হাওয়া পাল্টে দিয়েছি।”
বিজেপির জ্যোতির্ময় আবার মনে করেন, হওয়া-টাওয়া সব খাতায়-কলমে, পুরুলিয়ায় বইছে মোদীজির হাওয়া। তাঁর কথায়, “গত বারের থেকে বেশি ভোটে জিতব। গত বারের বিধানসভায় যে সব এলাকায় তৃণমূল জিতেছিল, সেই সব এলাকাতেও আমাদের জনসমর্থন দেখে আসুন।’’
বাঘমুণ্ডি, মানবাজার, জয়পুর, বলরামপুর, পুরুলিয়া, কাশীপুর এবং পাড়া— এই সাত বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে পুরুলিয়া লোকসভা আসন। দুর্নীতির অভিযোগ আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে ঘাসফুল কি পুরুলিয়ায় টলমলে? তৃণমূল প্রার্থী শান্তিরাম মাহাতোর বক্তব্য, ‘‘মনগড়া অভিযোগ। কুড়মিদের অনেক ভাগ। তবে কুড়মিদের বেশিরভাগ অংশটাই আমাদের দিকে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘ভোট কাটাকাটির ভয়টা বিজেপির থাকতে পারে। আমাদের বরং লাভ।’’ শান্তিরামের মতে, দুর্নীতির তদন্ত যে কেন্দ্র করছে, তা কতটা নিরপেক্ষ, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
ভোট ভাগ নিয়ে চিন্তা আছে সব শিবিরেই। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ যখন প্রশ্ন করছেন— কে আমাদের জন্য কী করেছে? ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর মাওবাদীরা বাঘবিন্ধ্যা ও তার আশপাশের গ্রামের ফরোয়ার্ড ব্লকের সাত জন কর্মীকে খুন করেছিল। তার পরে রাজ্যপাল সে গ্রামে এসেছিলেন। ওই গ্রামের রাস্তা পাকা হয়েছিল। কিন্তু সেই রাস্তার মাঝ বরাবার ফাটল। পটমারি গ্রামে জলের মধ্যে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছিলেন রথীন মাহাতো। বলেন, “মাওবাদী ভয়টা গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু গ্রামগুলোকে হাতির হানা থেকে রক্ষা করতে পারছে কেউ?”
ছৌ মুখোশের জন্য বিখ্যাত চড়িদা গ্রামের শিল্পী রাকেশ, অজয় সূত্রধরেরা বলেন, “শিল্পীদের কথা কেউ কি ভেবেছেন? প্রায়ই লোডশেডিংয়ে ডুবে থাকে গ্রাম। মোমবাতি জ্বেলে কাজ করতে হয়। চোখের বারোটা বেজে যাচ্ছে।’’ তাঁদের কথায়, ‘‘কয়েক কিলোমিটার দূরে অযোধ্যা পাহাড়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। অথচ প্রদীপের নীচেই অন্ধকার।”
পুরুলিয়া শহরে কার্যালয়ে বসে আদিবাসী কুড়মি সমাজের প্রার্থী অজিত মাহাতো দাবি করেন, “পুরুলিয়ার অন্ধকার আমরাই দূর করব। সব সম্প্রদায়ের মানুষের ভোটই আমার দিকে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘পুরুলিয়ার জঙ্গল কাটা পড়ছে। প্রকৃতিও বাঁচাতে হবে।”
স্থানীয় যুবক দেবীলাল মাহাতো বলেন, “ভোট কাটাকাটির খেলায় তৃণমূল ‘অ্যাডভান্টেজ’ পেয়ে যেতে পারে। ওদের যে নিজস্ব ভোট, সেটা তো অটুট আছে। তবে তাতে সাধারণ মানুষের কোনও লাভ হবে কি?’’ তিনি বলেন, ‘‘গ্রামের স্কুলে শিক্ষক নেই। হুটমুড়া প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে ডাক্তারের অভাবে চিকিৎসা হয় না।” পুনিয়া, হাড়মাডি, কলাবনি, সিরকাবাদ গ্রামগুলোয় এই সব নিয়েই আলোচনা।
তবে ভোট বড় বালাই। অঙ্কের হিসাব কষছেন সব প্রার্থীই। অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে ভুদা গ্রামে দেখা হল রাজেন লায়ারের সঙ্গে। পুরুলিয়ায় রোজ কাজ মেলে না। তাই বেঙ্গালুরুতে মজুরের কাজ করতে যান। এখন ছুটিতে বাড়িতে। কেউ আবার কাজের খোঁজে গিয়েছেন রাঁচী। ভুদা গ্রামের দেওয়ালে প্রচার নেই। রাজেন বলেন, “ভোট বটেক জানি। কবে বটেক, জানি নাই। আগের দিন জানতে পারব। হাড়িয়া নিয়ে আসবেক সবাই।’’
এই ভাবেই ভোট এগিয়ে আসে পুরুলিয়ায়।