Lok Sabha Election 2024

‘কারও সাহস নেই শিবিরে ভোট চাওয়ার’

খুনসুটিতে ভাগ বসাতে তত ক্ষণে পিছল-কালো শরীর নিয়ে হাজির থেনথেন। তার নিয়ন্ত্রণ শক্ত হাতে ধরে রেখেছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া মালকিন লালসেনবি।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

ইম্ফল শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:০৮
Share:

—প্রতীকী ছবি।

ভাষার দেওয়ালে মাথা খুঁড়ছিল কথার পাহাড়। কিন্তু শৈশব কবেই বা কথার তোয়াক্কা করেছে? একরাশ হাসি নিয়ে পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিন বছরের শরীরটা। কোথাকার কোন অচেনা লোক, নীল ঝোলা কাঁধে তার পরিবারের ত্রস্তপর্বের বিবরণ টুকছিল। ঝপাং করে তার পিঠে চেপে বসে তিন বছর। ভাষার দরকারই হল না, ছোট্ট লিলি দিব্যি আবদারে বুঝিয়ে দিল, তোমাদের গোমড়া কথা ছাড়ো, হাতের মোবাইলটা দাও তো দেখি! মেয়ের কাণ্ড দেখে চোখের জল লুকোন মা।

Advertisement

খুনসুটিতে ভাগ বসাতে তত ক্ষণে পিছল-কালো শরীর নিয়ে হাজির থেনথেন। তার নিয়ন্ত্রণ শক্ত হাতে ধরে রেখেছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া মালকিন লালসেনবি। গত বছর মে মাসে তার বাড়িতে যখন আগুন লাগানো হচ্ছিল, থেনথেন তখন কয়েক মাসের শিশু। নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করে বাবা ধীরেন চান্দাম ৬ জনের পরিবার নিয়ে পাড়া থেকে পালাচ্ছিলেন, ছোট্ট মেয়েটা তখনও পোষ্য কুকুরকে সন্তানস্নেহে বুকে আঁকড়ে রয়েছে। তার পরে কখনও সেনার শিবির, কখনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে রাত কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত ইম্ফলের ওখাংয়েইয়ের আশ্রয় শিবিরে থিতু হয়েছেন তাঁরা। লালসেনবি আর থেনথেনের চোরপুলিশ খেলা এখন প্রাণ জাগিয়ে রাখে প্রাসাদচত্বরের শিবিরে। কোইজাম গোবিন্দ ছিলেন মোরেতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বোর্ডে ব্যস্ত থাকা আঙুল এখন ত্রাণ শিবিরের বাইরের অস্থায়ী বাজারে দক্ষ হাতে গাজর, মটর, শিম বেচতে ব্যস্ত। সাংবাদিকের পরিচয় পেতে হেসেই বললেন, “ক্যয়া করেগা, মাস্টার সে ভেন্ডর বন গ্যয়া।” ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে অতিথিকে নিজের ছাতার তলায় আশ্রয় দিয়ে মাস্টারমশাই জানান, তিন মাসের মেয়েকে কোলে করে যাযাবর জীবন শুরু হয়েছিল। ১১ মাসে সাত জায়গা ঘুরে ইম্ফলের বর্তমান শিবিরে উঠেছেন। স্থানীয় ক্লাব আইডিপি-দের (ইন্টার্নালি ডিসপ্লেসড পিপল) জন্য ভোর ৪টে থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত অস্থায়ী বাজার গড়ে দিয়েছে। এখন সেই রোজগারই ভরসা হেডস্যারের।

ভোটমুখী রাজ্যে নির্বাচন কমিশন শিবিরবাসীর জন্যও বিশেষ বুথের ব্যবস্থা করছে। কিন্তু যে শিবিরেই যাই, ভোটের কথা মুখে আনলেই ফুঁসে উঠছে মানুষ। মৈরাংয়ের তরুণী তাখলেম্বাম লাংচিয়েম্বি বিএড পড়ছেন। ইচ্ছে ছিল শিক্ষক হওয়ার। বললেন, ‘‘প্রথম বার ভোট দেওয়ার উত্তেজনা দূরের কথা, এমন ভাবে পরিস্থিতি অশান্ত-জটিল করে রেখে ভোট করানোয় শুধুই রাগ জমছে মনে। কারও সাহস নেই ত্রাণ শিবিরে এসে ভোট চাওয়ার। সব দল সমান। সংঘর্ষ নিয়ে প্রথম থেকে শুধুই রাজনীতি চলছে। আমরা নেহাতই উলুখাগড়ার দল। নির্বাচন নয়, আগে আমাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা হোক।’’ শিবিরবাসী বাচ্চাদের জন্য সরকার আশপাশের স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে বটে, কিন্তু তাদের মনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের খবর নেওয়ার সময় কারও নেই। পিস কমিটির সদস্য বা সমাজ কল্যাণ দফতরের কর্মীরা অসহায়। বলছেন, শিবিরবাসীর খাবার ব্যবস্থা করাই বড় সমস্যা।

Advertisement

রাজ্য শিশু অধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কেইশাম প্রদীপকুমারের হিসাব, সংঘর্ষে ঘরছাড়া ৭০ হাজারের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার শিশু ও শিক্ষার্থী। মেইতেইদের ৪ জন ও কুকিদের ১১ জন শিশু মারা গিয়েছে। এখনও নিখোঁজ শিশু ২৮ জন। তাঁর মতে, শিবিরবাসী বাচ্চাদের সামাজিক জীবন শেষ। সংঘাতের আবহে দশম-দ্বাদশের অনেকে অ্যাডমিট কার্ড ছিঁড়ে বন্দুক হাতে ছবি লাগিয়েছে ফেসবুকে। এই মানসিক অভিঘাতের পরিমাপ করা ও উপশমের কোনও বিজ্ঞানসম্মত পন্থা গ্রহণ করতে পারছে না সরকার। পরিস্থিতি হয়তো কয়েক মাসে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিশলয় মনে এই আগুন আজীবন বয়ে বেড়াবে পরের প্রজন্ম।

হিরোশিমার মৃত্যু উপত্যকায় জিয়ন কাঠি হয়ে অলিয়েন্ডার ফুটেছিল। তেমনই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, ওরা সবাই মিলে একসঙ্গে হেসে উঠলে হিংসার সাধ্য নেই শুভবুদ্ধির পথ আটকায়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement