রাহুল গান্ধী। — ফাইল চিত্র।
তিন দিন ধরে হেঁটে এই শহরে এসেছিলেন রাহুল গান্ধী গত বছরের শীতে। আর গত মাসে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এলেন, তিন দিন আগে থেকে রাস্তা বন্ধ থাকল। ট্যাক্সি, অটো কিছুই না চালাতে পেরে রোজগার বন্ধ থাকল চালকদের। সেই সঙ্গে ছিল হাজারো হয়রানি।
উষ্মা স্পষ্ট মনজুর আলি শেখের গলায়। প্রবীণ বাহনচালক এই মনজুর উপত্যকার বিভিন্ন ওঠাপড়া, হামলা, জঙ্গি সন্ত্রাসের সাক্ষী। কথা বলে মনে হল, জীবনের গোধুলিপর্বে এসে একটু শান্তিতে বাকিটুকু নির্বাহ ছাড়া বড় কোনও চাওয়া পাওয়া নেই। কিন্তু এই শান্তিটুকু রাষ্ট্র যে দিতে পারবে না, শ্রীনগরের পথে পথে ঘুরে এই অভিজ্ঞানটুকু হয়ে গিয়েছে তাঁর।
তাঁর সঙ্গেই এসেছি শের-ই-কাশ্মীর স্টেডিয়ামের কাছে, যেখানে তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রা শেষ করেছিলেন রাহুল গান্ধী। সেই সভায় হাজিরা দিয়েছিলেন মনজুর। নিজের উৎসাহে। বলছেন, “আর যাই হোক, সরকারি লোকজনকে বাসে ভরে ভরে, হুমকি দিয়ে ওঁর সভা ভরাতে হয়নি,” এইটুকু বলেই চেপে গেলেন মনজুর। সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক কাশ্মীরের সভা নিয়ে তুলনামূলক আর কিছু বলাটা সঠিক হবে না ভেবেই হয়তো। শ্রীনগরে কংগ্রেসের সমাজমাধ্যমের কর্তা জাভেজ আহমেদের সেই ভয় নেই। এক বছর আগে রাহুলের সেই সভা এবং সাম্প্রতিক কালে মোদীর কাশ্মীরের সভার মধ্যে তুলনা করলেন তিনি ‘মহব্বৎ বনাম জবরদস্তি’ হিসেবে। তাঁর কথায়, “সে দিন আমরা দেখেছি রাহুলজিকে ঘিরে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস। ফুল তো ছিলই, বাদাম দিয়ে তৈরি মালা, নোটের মালা নিয়ে দূর দূর থেকে মানুষ এসেছিলেন তাঁকে বরণ করতে। বরফ পড়ছে তখন, কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ ছিল না রাহুল গান্ধীর।”
তবে রাহুলের আসা নিয়ে মনজুরের মতো বাসিন্দাদের উচ্ছ্বাস যেমন সত্যি, এটাও বাস্তব যে তার ফলে কাশ্মীরে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে বিরাট কোনও পরিবর্তন আসবে না। কিন্তু কাশ্মীরে সাধারণ ভাবে মিইয়ে থাকা একটি দলের মধ্যে কিছুটা হলেও রক্ত সঞ্চালন যে রাহুল করতে পেরেছিলেন তা দলীয় কার্যালয় এবং স্থানে স্থানে কংগ্রেস নেতাদের আত্মপ্রত্যয়ে স্পষ্ট। জম্মু-কাশ্মীরের কংগ্রেসের সভাপতি গুলাম নবি মোঙ্গা যেমন বললেন, “রাহুলের সফরের সময়ে প্রায় সর্বক্ষণই ওঁর সঙ্গে ঘুরেছি। ছাত্রছাত্রী, সব বয়সের মহিলা এবং বাচ্চাদের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ওঁর কাছে আসতে দেখেছি। কাশ্মীরের হৃদয়ে উনি একটা জায়গা করে নিয়েছেন, এটুকু বলা যায়। মানুষের কংগ্রেসের কাছে একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। দায় দফায় কোনও রাজনৈতিক নেতাকে পাওয়া যায় না কারণ দশ বছর ভোট নেই। পুলিশ প্রশাসন মুসলিমদের কথা শুনছে না। সব দরগা, মসজিদের যে কেন্দ্রীয় সংস্থা সেই ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারপার্সন এখন এক জন বিজেপি নেত্রী। ফলে এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সক্রিয়তা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন রাহুল। উনি খুবই শীঘ্র আবার আসবেন ।”
কাশ্মীরের তিনটি লোকসভা আসনে এ বার কৌশলী পুর্নবিন্যাস করেছে বিজেপি, এমনটাই দাবি কংগ্রেসের। বারামুলা, শ্রীনগর এবং অনন্তনাগ আসনে এ বার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। অনন্তনাগের নির্বাচনী ক্ষেত্রে রাজৌরি এবং পুঞ্চের কিছু এলাকা মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা আগে ছিল জম্মু লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই রাজৌরি এবং পুঞ্চে হিন্দু জনসংখ্যা বেশি। লাভ বিজেপির। এই তিনটি আসনই ২০১৪ সালের আগে ছিল এনসি-র দখলে। এ বারেও ওমর আবদুল্লা শ্রীনগর থেকে, রহুল্লা মেহদি বারামুলা থেকে এবং মিঞা আলতাফ অনন্তনাগ থেকে প্রার্থী হবেন বলে খবর। কিন্তু অনন্তনাগ আসনটি চাইছেন পিডিপি-র মেহবুবা মুফতিও। রাহুলকে ঘিরে আবেগ থাকলেও এখানে কংগ্রেস যে ‘ইন্ডিয়া’র ‘বড় দাদা’ হিসেবে একটি আসন পাবে, এমন সম্ভাবনা কম। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেস, এনসি এবং পিডিপি-র মধ্যে ঐক্য যদি ক্ষুণ্ণ হয়, লাভ বিজেপিরই। দীর্ঘকাল ধরে কাশ্মীরের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ ইউসুফ তারিগামি বলছেন, “শুধু পিডিপি কেন, আমি তো যারা ইন্ডিয়া জোটের অঙ্গ নয়, জম্মু ও কাশ্মীরের এমন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির কাছেও আবেদন রাখছি, অবশ্যই তারা এগিয়ে এসে কাঁধে কাঁধ মেলাক। কারণ এ বার গণতন্ত্রের সামনে চ্যালেঞ্জ কাশ্মীরের তিনটি আসনেই।”
এনসি-র মুখপাত্র তনভির সিদ্দিকীর কথায়, “আমাদের সমস্যার আসল যে দিকগুলি, সেগুলি বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সেই ভোট তো হচ্ছে না। মানুষের ভোটে জিতে আসেননি এমন সব ব্যক্তি ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, আমাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কোথাও কোনও মানুষের প্রতিনিধিত্ব নেই।” এনসি চায়, লোকসভা ভোটে কাশ্মীরের তিনটি আসনেই তাদের কংগ্রেস এবং পিডিপি পূর্ণ সমর্থন করুক। কিন্তু সেটা হওয়ার সম্ভাবনা, এখানে শীঘ্র বিধানসভা ভোট হওয়ার মতোই অলীক দেখাচ্ছে।
(চলবে)