ওমর আবদুল্লা এবং মেহবুবা মুফতি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
জম্মু ও কাশ্মীর। একটিমাত্র সংযোজক অব্যয় দিয়ে জুড়ে থাকা দু’টি এলাকার মধ্যে আছে যেমন ভৌগোলিক অবস্থানগত ফারাক, তেমনই রয়েছে রাজনৈতিক বৈপরীত্য। বৈপরীত্য রয়েছে পাঁচ বছর আগের কাশ্মীর আর ২০২৪ সালের কাশ্মীরের মধ্যেও। ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দারা যখন তাঁদের লোকসভার দূত বেছে নিতে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, তখনও ভূস্বর্গের বিশেষ মর্যাদা (অনুচ্ছেদ ৩৭০) অবলুপ্ত হয়নি। রাজ্যের মর্যাদা খুইয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়নি জম্মু ও কাশ্মীর। তখনও পর্যন্ত লাদাখ কাশ্মীরেরই অংশ ছিল। মাঝে ঝিলম আর চেনাব নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে।
তবে পাঁচ বছর পরে এই লোকসভা নির্বাচনেও জম্মু এলাকার দু’টি লোকসভা আসন উধমপুর এবং জম্মুতে জয় পেয়েছে বিজেপি। কাশ্মীর উপত্যকার ফলে অবশ্য চমক আছে। বারামুলা কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী শেখ এর রশিদের কাছে ২ লক্ষেরও বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)-এর নেতা ওমর আবদুল্লা। অনন্তনাগ রাজৌরি আসনে এনসি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পিপল্স ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)-র মেহবুবা মুফতি। শ্রীনগর আসনটিও ধরে রেখেছে এনসি।
২০১৯ সালের অগস্টে কাশ্মীরে বিশেষ মর্যাদার অবলুপ্তি ঘটায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। স্থানীয় নেতাদের ‘গৃহবন্দি’ করে রাখার অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় জম্মু ও কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেখানে বিধানসভা নির্বাচন করারও নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। তাই লোকসভা ভোটের সঙ্গেই বিধানসভা নির্বাচনের দামামাও বেজে গিয়েছে সেখানে।
কাশ্মীরের ভোট রাজনীতিতে বরাবরই ‘কাশ্মীরিয়ৎ’ বা সেখানকার আঞ্চলিক অস্মিতা বড় ভূমিকা নিয়েছে। তবে এই কাশ্মীরিয়তের আবেদন কাশ্মীর উপত্যকায় যতটা আছে, তার ছিটেফোঁটাও নেই জম্মুতে। বিভিন্ন দলের নির্বাচনী প্রচারে বার বার উঠে এসেছে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির প্রসঙ্গ। কেন্দ্রের শাসকদল দাবি করেছে, বিশেষ মর্যাদা অবলুপ্ত হওয়ার পর কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদে লাগাম পরানো গিয়েছে। বিরোধী দলগুলি পাল্টা দাবি করেছে, বিরোধী কণ্ঠ দমন করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
সাবেক জম্মু ও কাশ্মীরে ছিল মোট ছ’টি লোকসভা আসন। বর্তমানে লাদাখ পৃথক হয়ে যাওয়ায় আসনের সংখ্যা পাঁচটি। এর মধ্যে তিনটি আসন কাশ্মীর উপত্যকায়। দু’টি আসন জম্মুতে। অবশ্য আসন পুনর্বিন্যাসের পর কাশ্মীরের সাবেক অনন্তনাগ আসনটির মধ্যে ঢুকেছে জম্মুর বিস্তীর্ণ একটি অংশ। আসনটির নতুন নাম হয়েছে অনন্তনাগ-রাজৌরি। পুনর্গঠিত হয়েছে শ্রীনগর এবং বারামুলা আসনও। গত লোকসভা নির্বাচনে জম্মু অঞ্চলের দু’টি আসনেই পদ্ম ফুটেছিল। উপত্যকার তিনটি আসনে জিতেছিল ফারুক এবং ওমর আবদুল্লার এনসি। তবে কংগ্রেস, বিজেপি, এনসি ছাড়াও একাধিক স্থানীয় চরিত্র রয়েছে কাশ্মীরের ভোটের মহাভারতে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল বা পঞ্জাবের মতোই জম্মু ও কাশ্মীরে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র মধ্যে সার্বিক বোঝাপড়া হয়নি। ভূস্বর্গে কংগ্রেস এবং এনসি আসন সমঝোতা করে লড়লেও একাই লড়ছে সে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির দল পিডিপি।
পিডিপি-র পুরনো ‘গড়’ অনন্তনাগ-রাজৌরি থেকে এ বারেও প্রার্থী হয়েছিলেন মেহবুবা। তাঁর লড়াই মূলত ছিল ‘ইন্ডিয়া’র শরিকদল এনসি-র প্রার্থী মিয়াঁ আলতাফের সঙ্গে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিলেন এনসি-র হাসনাইন মাসুদি। দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস। আর ২০০৪ এবং ২০১৪ সালে অনন্তনাগ আসন থেকে জিতে লোকসভায় যাওয়া মেহবুবা চলে গিয়েছিলেন তৃতীয় স্থানে। পেয়েছিলেন মাত্র ২৪.৪৪ শতাংশ ভোট। এই আসনে এ বার প্রার্থী হয়েছিলেন জম্মু ও কাশ্মীর ‘আপনি পার্টি’র জ়াফর মানহাস। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিল প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজ়াদের প্রগ্রেসিভ আজ়াদ পার্টি এবং সাজাদ গনি লোনের জম্মু ও কাশ্মীর পিপল্স কনফারেন্স (জেকেপিসি)।
উপত্যকার অপর ‘তারকা’ কেন্দ্র শ্রীনগর। ২০১৪ সাল বাদ দিলে গত দু’দশকে এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন ফারুক বা ওমর আবদুল্লা। এ বার অবশ্য ‘পারিবারিক গড়’ শ্রীনগর ছেড়ে পড়শি কেন্দ্র উত্তর কাশ্মীরের বারামুলার প্রার্থী হয়েছিলেন ওমর। বয়সজনিত কারণে ভোটে লড়েননি শ্রীনগরের বিদায়ী সাংসদ ফারুক। এই কেন্দ্রে লড়াই ছিল মূলত এনসি প্রার্থী তথা শিয়া ধর্মগুরু আগা সৈয়দ রুহুল্লা মেহদির সঙ্গে পিডিপি-র ওয়াহিদ পাররার। আর বারামুলা কেন্দ্রে মূল লড়াই ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমরের সঙ্গে পিপল্স কনফারেন্সের প্রধান সাজ্জাদ লোনের। তবে লড়াইয়ে ছিল মেহবুবার দলও। গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল ওমরের দল। দ্বিতীয় স্থানে ছিল পিপল্স কনফারেন্স। এক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হুরিয়তের সঙ্গে যুক্ত সাজ্জাদ নির্বাচনী প্রচারমঞ্চগুলি থেকে যে ভাবে ওমরকে আক্রমণ করছিলেন, তাতে অনেকেই বিজেপির কথার ‘প্রতিধ্বনি’ শুনেছিলেন। সাজ্জাদ দাবি করেছিলেন, বারামুলা কেন্দ্রের ১০ জন প্রাক্তন সাংসদের মধ্যে ৯ জনই ওমরের দলের সদস্য হলেও উত্তর কাশ্মীরের এই কেন্দ্র উন্নয়নের প্রশ্নে অবহেলিতই থেকে গিয়েছে। ঘটনাচক্রে, উপত্যকার দলগুলি সম্পর্কে একই অভিযোগ বার বার করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও।
হিন্দুপ্রধান জম্মু লোকসভা কেন্দ্রে ২০১৪ সাল থেকেই জয় পেয়ে আসছে বিজেপি। এই কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ যুগলকিশোর শর্মাকে এ বারেও টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। প্রার্থী বদল করেনি কংগ্রেসও। ২০১৯ সালে যুগলের কাছে পরাজিত রমন ভাল্লাকে এ বারেও টিকিট দিয়েছিল ‘হাত’ শিবির। জম্মুর মতোই পড়শি কেন্দ্র উধমপুরে গত এক দশক ধরে বিজেপির দখলে। গত দু্’বারের মতো এ বারেও এখানকার পদ্মপ্রার্থী ছিলেন বিদায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য জিতেন্দ্র সিংহ। কংগ্রেস এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছিল চৌধরি লাল সিংহকে। আসন সমঝোতার সূত্র অনুযায়ী জম্মুর দুই কেন্দ্রে প্রার্থী দেয়নি এনসি। তেমনই ‘ইন্ডিয়া’র স্বার্থে অনন্তনাগ-রাজৌরি, শ্রীনগর, বারামুলায় ফারুকের দলকে সমর্থন জানিয়েছিল কংগ্রেস। এনসি-র প্রতি ‘অভিমান’ থেকে উপত্যকার তিন আসনে আলাদা লড়লেও জম্মু এবং উধমপুরে কংগ্রেসকে সমর্থন করার কথা জানিয়েছিলেন মেহবুবা।
‘বদলে যাওয়া’ কাশ্মীর এ বার একাধিক অভিনব ঘটনার সাক্ষী ছিল। বারামুলা কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল ৫৮.১৭ শতাংশ। গত চার দশকে কখনও এই কেন্দ্রে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এত বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। ১৯৮৪ সালে শেষ বার এই কেন্দ্রে ৬১.০৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। তার পর থেকে ভোটদানের হার ক্রমশ কমেছে। এ বার শ্রীনগর কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ। ২০১৯ এবং ২০১৪ সালে এই কেন্দ্রে ভোটদানের হার ছিল যথাক্রমে ১৪.৪৩ শতাংশ এবং ২৫.৮ শতাংশ। শ্রীনগরে ৪০ শতাংশের উপর ভোট পড়েছিল ২৮ বছর আগে, ১৯৯৬ সালে। ভোটের হারে এই বৃদ্ধিকে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সাফল্য’ বলেই দেখাতে চেয়েছে বিজেপি।
জম্মু ও কাশ্মীর নানাবিধ কারণে প্রায় সর্বদাই জাতীয় রাজনীতির আলোচ্য বিষয় থেকেছে। কখনও সন্ত্রাসবাদী হানা, কখনও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকা থেকে বিতাড়ন— ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাশ্মীর প্রসঙ্গ এসেছে নির্বাচনী প্রচারে। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সেনার গাড়িতে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়। বিরোধী দলগুলির বক্তব্য, ওই ঘটনাকে ‘হাতিয়ার’ করে বিজেপি গোটা দেশে জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করেছিল। তার জোরেই বিপুল জনাদেশ নিয়ে ফের দিল্লির মসনদ দখল করেছিল তারা।
কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে দীর্ঘ দিন ভারতের মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির তেমন ‘বনিবনা’ নেই। নির্বাচনী ইতিহাস অন্তত তেমনটাই বলে। বিজেপি এ বার উপত্যকার তিন কেন্দ্রে প্রার্থী দেয়নি। কেউ কেউ মনে করছেন, এ হল উপত্যকার দলগুলির উপর ‘আস্থা’ রাখার ইঙ্গিত। আবার অন্য একটি অংশ মনে করছে, আসলে ‘আপনি পার্টি’ এবং পিপল্স কনফারেন্সের আড়ালে উপত্যকায় এনসি এবং পিডিপির বিরুদ্ধে লড়েছে বিজেপিই। পদ্মশিবির অবশ্য সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছিল। বিজেপির বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ উঠেছিল। আসন পুনর্বিন্যাসের পর অনন্তনাগ লোকসভা নির্বাচনী এলাকায় রাজৌরি এবং পুঞ্চের কিছু এলাকা মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা আগে ছিল জম্মু লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে রাজৌরি এবং পুঞ্চে হিন্দু জনসংখ্যা বেশি। যেখানে বিজেপি শক্তিশালী। পিডিপি, এনসি-র মতো উপত্যকার দলগুলির দাবি, সোজা পথে না-পেরে বাঁকা পথে কাশ্মীর ‘দখল’ করার চেষ্টা করেছে পদ্মশিবির।
ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক শোভার কারণে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পড়শি দুই দেশ চিন এবং পাকিস্তান পরিবেষ্টিত ভূস্বর্গে শান্তি এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখা নয়াদিল্লির কাছেও জরুরি। জরুরি ‘কাশ্মীরিয়ৎ’-কে গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ কাশ্মীরিদের পূর্ণ আস্থা অর্জন করাও। এই আবহে কাশ্মীরের এই ফলাফল আগামী দিনের জন্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।