কেমন গেল দেশের প্রথম দফার লোকসভা ভোট? ছবি: পিটিআই
২১ রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ১০২টি আসনে প্রথম দফায় লোকসভা ভোট হল শুক্রবার। ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন বলল, মোটের উপর শান্তিপূর্ণ, অবাধ এবং সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। তবে বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনাও ঘটেছে। প্রথম দফার ভোটে পশ্চিমবঙ্গ এবং মণিপুরের কিছু জায়গা থেকে গন্ডগোলের খবর মিলেছে। তার মধ্যে ‘অন্যতম’ আবারও কোচবিহারের শীতলখুচি। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে শীতলখুচির ১২৬ নম্বর বুথের বাইরে গুলি চলার ঘটনায় প্রাণ যায় চার গ্রামবাসীর। আঙুল ওঠে বুথে দায়িত্বে থাকা সিআইএসএফ জওয়ানদের দিকে। এ বার তাই শীতলখুচি নিয়ে বিশেষ সাবধানি ছিল কমিশন। তবুও অশান্তি এড়ানো গেল না। তৃণমূলের অভিযোগ, কোচবিহারের শীতলখুচিতে ভোটারদের ভয় দেখিয়েছে বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। মণিপুরের থামানপোকপির একটি বুথের সামনে ‘অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী’দের বিরুদ্ধে উঠল গুলি চালানোর অভিযোগও। যদিও তার পরেও মানুষ নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছেন। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম দফায় বাংলার তিন লোকসভা আসনেই গড় ভোট পড়েছে ৭৭.৫ শতাংশ। সারা দেশের মধ্যে সর্বাধিক ভোট পড়েছে ত্রিপুরায় (৭৯.৯০ শতাংশ) আর মণিপুর রাজ্যে ভোট পড়েছে ৬৮.৬২ শতাংশ। শতাংশের বিচারে প্রথম দফায় সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে বিহারে। মাত্র ৪৭.৪৯ শতাংশ।
বিক্ষিপ্ত কিছু অশান্তি, গন্ডগোল এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষের কথা বাদ রাখলে ‘ভাল’ কিছু দৃশ্যও চোখে পড়েছে প্রথম দফার নির্বাচনে। যেমন, উত্তরাখণ্ডের নৈনিতালের একটি বুথে দেখা গেল বিয়ের পোশাকেই ভোট দিতে এসেছেন নবদম্পতি। গায়ত্রী চন্দোল নামে নববধূ জানান, গত রাতেই বিয়ে হয়েছে তাঁর। শ্বশুরবাড়িতে এসেই সকাল সকাল স্বামীকে নিয়ে এসেছেন নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে। শুধু উত্তরাখণ্ডই নয়, আরও কয়েকটি জায়গায় নবদম্পতিদের ভোটকেন্দ্রে আসার ছবি দেখা গিয়েছে।
শুক্রবার প্রথম দফায় বাংলার তিনটি আসনে ভোট হয়েছে। তিনটিই উত্তরবঙ্গে। তামিলনাড়ুর ৩৯টি, উত্তরাখণ্ডে পাঁচটি, অরুণাচল প্রদেশে দু’টি, মেঘালয়ে দু’টি, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে একটি, মিজোরামে একটি, পুদুচেরির একটি, সিকিমের একটি এবং লক্ষদ্বীপে একটি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। এ ছাড়া রাজস্থানের ১২টি আসনে, উত্তরপ্রদেশে আট, মধ্যপ্রদেশে ছয়, অসম এবং মহারাষ্ট্রে পাঁচ, বিহারের চার, মণিপুরের দু’টি, ত্রিপুরা, জম্মু-কাশ্মীর এবং ছত্তীসগঢ়ের একটি করে আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। উল্লেখ্য, যে ১০২টি আসনে শুক্রবার ভোট হল, তার ৪১টিতে গত বার লোকসভা ভোটে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট পেয়েছিল ৩৫টি আসন।
কোন রাজ্যে কত ভোট পড়ল
সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভোটদানের হিসাবে নির্বাচন কমিশন যে তথ্য দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে প্রথম দফায় সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ত্রিপুরায়— ৭৯.৯ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। ভোট পড়েছে ৭৭.৫৭ শতাংশ। সবচেয়ে কম ভোট পড়ল বিহারে— ৪৭.৪৯ শতাংশ। আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভোট পড়েছে ৫৬.৮৭ শতাংশ। অরুণাচল প্রদেশে ভোট পড়েছে ৬৫.৪৬ শতাংশ। অসমে ৭১.৩৮, ছত্তীসগঢ়ে ৬৩.৪১, জম্মু-কাশ্মীরে ৬৬.০৮, লক্ষদ্বীপে ৫৯.০২, মণিপুরে ৬৮.৬২, মেঘালয়ে ৭০.২৬, মিজোরামে ৫৪.১৮, নাগাল্যান্ডে ৫৬.৭৭, পুদুচেরিতে ৭৩.২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। রাজস্থানে ৫০.৯৫, সিকিমে ৬২.১৯, তামিলনাড়ুতে ৬২.১৯, উত্তরপ্রদেশে ৫৭.৬১, উত্তরাখণ্ডে ৫৩.৬৪ শতাংশ ভোট পড়েছে।
ভোট এবং অভিজ্ঞতা
প্রথম বার লোকসভা ভোটে অংশ নিলেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারী প্রায় আড়াই হাজার ত্রিপুরাবাসী। সকাল হতেই ত্রিপুরা সীমান্তের গেট খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভৌগোলিক কারণেই তাঁদের বাস সীমান্তের ও পারে। প্রথম বার ভোট দিয়ে আড়াই হাজার মানুষ জানালেন, প্রশাসনের তরফে যে সহযোগিতা পেলেন তাতে তাঁরা ভীষণ খুশি।
আবার, নাগপুরের এক একান্নবর্তী পরিবারের ২৭ জন সদস্য একসঙ্গে ভোট দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমকে তাঁরা জানালেন, এক দিন আগে পরিবারের প্রবীণ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তবে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যেরা চলে এসেছেন।
হরিদ্বারে ৭০ বছরের এক ভোটার ভোট দিতে এসে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেন ইভিএম। তাঁর দাবি, ভোট করাতে হবে ব্যালটে। পুলিশ জানিয়েছে, ইভিএম কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সেটা দিয়েই ভোট হয়েছে। অন্য দিকে, রণধীর নামে ওই প্রবীণ ভোটারকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।
ভোট এবং মৃত্যু!
ভোটের পাহারায় দাঁড়িয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ইন্ডিয়ান রিজ়ার্ভ ব্যাটেলিয়নের এক জওয়ানের। তাঁর বয়স মাত্র ২৮ বছর। মিজোরামের ঘটনা। আবার জলপাইগুড়ি লোকসভার ধূপগুড়িতে এক সিপিএম কর্মীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। ক্যাম্পে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
ভোটদান করলেন যে সব খ্যাতনামীরা
রাজ্যে রাজ্যে নানা চেনা মুখ তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করলেন শুক্রবার। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদম্বরম এবং তাঁর ছেলে শিবগঙ্গার কংগ্রেস প্রার্থী কার্তি চিদম্বরম ভোটদান করেছেন। অভিনেতা রজনীকান্ত, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে প্রধান এমকে স্ট্যালিন ভোট দিলেন শুক্রবার। ভোট নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত অস্কারজয়ী সঙ্গীত পরিচালক এআর রহমান। তিনি বলেন, ‘‘আমি ভোটের ফল জানার জন্য ভীষণই উৎসুক। ভোট সাধারণের জন্য। সাধারণের উপকারের জন্য ভোট।’’ভোটদান করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তথা কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক। উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে ভোট দিলেন স্বঘোষিত যোগগুরু রামদেব এবং তাঁর সংস্থা পতঞ্জলির ম্যানেজিং ডিরেক্টর আচার্য বালকৃষ্ণ।
ভোট-ছবি!
১) ভোটে বিক্ষিপ্ত অশান্তি দেখেছে কোচবিহার। কিন্তু ভোট শেষ হওয়ার পর যে দৃশ্য দেখল, তা বেনজিরই বটে। বুথ থেকে ইভিএম তখনও পৌঁছায়নি স্ট্রংরুমে। তার আগেই কোচবিহার শহরে ‘বিজয় মিছিল’ সেরে নিল ঘাসফুল এবং পদ্মশিবির। দু’দলই ভোট শেষ হতেই ‘বিজয় মিছিল’ বার করে শহরে। চলে মিষ্টিমুখের পালা, অনেকেই আবার আগেভাগে খেলে নেন আবিরও। সব মিলিয়ে, গণনার আগেই জয়ের দাবি করে ‘বিজয় মিছিলে’ মেতে উঠল কোচবিহার। যা দেখে অবাক জনতার প্রশ্ন, গণনার আগেই?
২) কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তথা কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক ভোট দেন ভেটাগুড়ি চৌপতি হাই স্কুলে। ৭/২৩৫ নম্বর বুথের ভোটার নিশীথ অভিযোগ করেন, মানুষকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভোটদান করতে বাধা দিচ্ছে শাসকদল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। কারণ, তাঁরা জানেন মানুষের ভোট এ বার তৃণমূলের বিপক্ষে। অন্য দিকে, কোচবিহার লোকসভার দিনহাটার ভেটাগুড়ি উত্তরপাড়া এলাকায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান কয়েক জন মহিলা। অভিযোগ, শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করছেন মন্ত্রী! উদয়ন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রীর দাবি, বেশ কয়েকটি অশান্তির ঘটনায় স্থানীয় বিজেপি পঞ্চায়েত সদস্যার স্বামী জড়িত থাকায় পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই বিজেপিকে সমর্থনকারী মহিলারা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।
৩) শিলিগুড়ি পুরনিগমের ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের একটিয়াশাল এলাকায় তিলেশ্বরী হাই স্কুলের নির্বাচনী কেন্দ্র বিকেল থেকেই উত্তপ্ত ছিল। ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিধানসভার বিধায়ক শিখা চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়ায়। অভিযোগ, সেখানে তৃণমূল সকাল থেকেই ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। বিধায়কের উপস্থিতিতে বিজেপি কর্মীরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে স্লোগান তুললে পাল্টা তৃণমূলও স্লোগান তোলে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে দেখে কেন্দ্রীয় বাহিনী-সহ ভক্তিনগর থানার পুলিশ লাঠি হাতে পরিস্থিতি সামলাতে মাঠে নামে। অন্য দিকে, ওই ঘটনার পরই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ভোটগ্রহণ কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন জলপাইগুড়ি লোকসভার পুলিশ অবজ়ার্ভার সিএস রাও। বুথে ঢুকেই ভুয়ো পোলিং এজেন্টকে ধরে ফেলেন তিনি। ভোটগ্রহণ কেন্দ্র থেকে তাঁকে টেনে বার করে দেন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাছে তিনি তথ্য নেন, কেন বাইরের মানুষ ওখানে রয়েছেন।
প্রথম দফা ভোটের শেষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বললেন, ‘বাম্পার ভোটিং’ হয়েছে। তাঁর দাবি, প্রতিটি রাজ্যের প্রতিটি বুথেই শোনা গিয়েছে ‘মোদী-মোদী’ রব। বস্তুত, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখলে পর পর তিন বার তারা শাসকের ক্ষমতায় থাকবে। আর এই প্রথম দফার ভোটে আলাদা করে নজর ছিল তামিলনাড়ুর দিকে। কারণ, প্রথম দফাতেই সে রাজ্যের ৩৯টি লোকসভা কেন্দ্রের প্রতিটিতে ভোট ছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বার বার সভা করতে গিয়েছেন দক্ষিণের ওই রাজ্যে। এ বার সেখানে ভাল ফলের আশা করছে পদ্মশিবির।