প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
বিপক্ষের আক্রমণের সূচিমুখটিকে বিপক্ষের দিকেই ঘুরিয়ে দেওয়া যুদ্ধের অন্যতম কৌশল। এতে একই সঙ্গে প্রত্যুত্তর দেওয়ার দায় বাঁচে, অন্য দিকে বিপক্ষকে আক্রমণ করার জন্য নতুন তিরও খুঁজতে হয় না। বিজেপির মূল প্রচারক নরেন্দ্র মোদী আজ সেটাই করলেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবির। আজ উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর, বাঁশগাঁওয়ের জনসভায় দাঁড়িয়ে তিনি ইন্ডিয়া মঞ্চের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগই আনলেন, যা গত তিন মাস ধরে কংগ্রেস-সহ ‘ইন্ডিয়া’র বিভিন্ন শরিক দল তাঁর বিরুদ্ধে এনে চলেছে। মোদীর কথায়, “ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এসে দেশের সংবিধান বদল করতে চায়। তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলছি আর ওরা মোদীকে গালি দিচ্ছে। ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ দেওয়ার ঘোর বিরোধী মোদী বুক চিতিয়ে ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবে।” তাঁর কথায়, “ইন্ডিয়ার নিশানায় দেশের পবিত্র সংবিধান কারণ নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ককে খুশি করতে তারা দলিত, জনজাতি, পিছড়ে বর্গের সংরক্ষণ লুট করে মুসলমানদের দিয়ে দিতে চায়।”
মোদীর ‘চারশো পারের’ স্লোগানকে ব্যাখ্যা করে কংগ্রেস অভিযোগ করেছে, মোদী আসলে সংবিধান বদল করার জন্যই এই সংখ্যার প্রত্যাশী। সংবিধান বদল করে মোদী দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করবেন। তার পর মোদী তার পাল্টা ভাষ্য দিতে শুরু করেন। প্রথম বলেন, কংগ্রেস তথা ‘ইন্ডিয়া’ মিথ্যা প্রচার করছে। অম্বেডকরের তৈরি সংবিধান অম্বেডকরও বদলাতে পারবেন না।
বাংলায় ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে হাই কোর্টের রায়ের পর মোদী তৃণমূল নেত্রীকে বারবার নিশানা করেছেন। আজও তিনি বলেন, “বাংলায় তৃণমূল জাল ওবিসি শংসাপত্র বানিয়ে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির সংরক্ষণ লুট করে মুসলমানদের দিয়ে দিয়েছিল। উত্তরপ্রদেশে এই তৃণমূলকে সমর্থন করছে এসপি।” প্রচার যে হেতু উত্তরপ্রদেশে, তাই অখিলেশ যাদবের এসপি-কেই আজ আক্রমণের মূল লক্ষ্য করেছেন মোদী। বলেছেন, “২০১২ সালের জানুয়ারিতে এই রাজ্যের ভোটের আগে নিজেদের ইস্তাহার প্রকাশ করে এসপি। সেখানে তারা বলে, দলিত, পিছিয়ে থাকা শ্রেণি যেমন সংরক্ষণ পেয়ে থাকে তেমনই মুসলমানদেরও সংরক্ষণ দেওয়া হবে। এসপি ঢাকঢোল বাজিয়ে বলেছিল, এটি করার জন্য তারা সংবিধানও বদলে দেবে। এরপর ২০১৪ সালের লোকসভার আগে ফের এসপি ইস্তাহারে মুসলমানদের সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করে।”
এ বারেও ফের মেরুকরণ করতে গিয়ে নিজের ‘চা বিক্রেতা’র পরিচয়কে ফের সামনে এনেছেন মোদী। কখনও কড়া স্বরে, কখনও হাল্কা চালে। বলেছেন, “আমি অতি পিছড়ে বর্গের সমাজ থেকে উঠে এসেছি। তাই আমি গরিবের দুঃখ জানি। ইন্ডিয়া বারবার চেষ্টা করছে দলিতের সংরক্ষণ মুসলমানকে দিতে। কিন্তু হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট তা আটকে দিচ্ছে। তাই কোর্ট-কাছারির এই ঝঞ্ঝাট খতম করতে পুরো সংবিধানটাকেই বদলাতে চাইছে ইন্ডিয়া। আপনারা কি সংবিধানের এই অপমান সহ্য করবেন?” তাঁর কথায়, “মোদী এবং চায়ের সম্পর্ক খুব জোরদার। আমি ছোটবেলা থেকে মানুষকে চা খাওয়াতে খাওয়াতে বড় হয়েছি। কাপ প্লেট ধুতে ধুতে বড় হয়েছি। ৪ জুন বিজয়ের সূর্য উঠবে, চার দিকে কমল ফুটবে।”
‘ইন্ডিয়া’কে আজ ‘ঘোর সাম্প্রদায়িক, জাতিবাদী এবং পরিবারবাদী’ হিসাবে চিহ্নিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সন্ত্রাসবাদীদের এসপি বরাবর সরকারে থাকার সময় ছাড় দিয়ে এসেছে। এসপি আমলে মাফিয়াদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে দেখা হত। এসপি সরকারের সময় জনতা ভয়ে কাঁপত। বিজেপি সরকার হওয়ার পর মাফিয়ারা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। আগে সরকারের জমিতে মাফিয়াদের প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল। যোগী আদিত্যনাথের সরকার অনেকের গরম কমিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপারে যোগীজি বিশেষজ্ঞ! মাফিয়াদের প্রাসাদের জায়গায় এখন গরিবের ঘর হচ্ছে। আমাজের সরকারের সঙ্গে ইন্ডিয়ার জোট সদস্যদের সরকারের এটাই তফাৎ।” একই সঙ্গে প্রচারে ফের পাকিস্তানকেও টেনে এনে মোদী বলেন, ‘‘পাকিস্তানে ইন্ডিয়া জোটের জন্য প্রার্থনা হচ্ছে। আর এ দিকে সীমান্তের দু’পার থেকেই ইন্ডিয়া-জেহাদিদের সমর্থন আসছে। ইন্ডিয়া জোট এখানে ভোট জিহাদ করছে।’’
এ বারের লোকসভা প্রচারে আগাগোড়া মাছ-মাস-মুসলমান-মোগল-মঙ্গলসূত্র জাতীয় নানা শব্দে বিরোধীদের আক্রমণ করেছেন মোদী। সর্বশেষ গত কাল ‘বিরোধীরা মুজরো করছেন’ জাতীয় কথাও বলেছেন। তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা হলেও মোদী দমার পাত্র নন।
এ বারে বিরোধীদের অন্যতম অস্ত্র বেকারত্ব এবং দুর্নীতি। তা নিয়ে প্রায় গোটা প্রচারপর্বে কোনও কথা না বললেও এ দিন উত্তরপ্রদেশে মোদী বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশ এ বারে ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র বানাবে। এটা অনেক আগেই হতে পারত। কংগ্রেস আটকে রেখেছিল। কারণ কংগ্রেস চাইছিল না যে অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে ভারত আত্মনির্ভর হোক। কারণ ইন্ডি জোট চায়, আরও বিদেশি ডিল হোক, দালালি হোক, বফর্স-অগুস্তা, কোয়াত্রোচ্চি মামার খেলা চলুক।’’