শ্যামবাজারের রোড-শোয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
লোকসভা নির্বাচনের সপ্তম ও শেষ দফার আগে রাজ্যে এসে তৃণমূল কংগ্রেসের পাশাপাশি সিপিএম ও কংগ্রেসেকেও তীব্র আক্রমণ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর দাবি, বাম ও কংগ্রেস দু’পক্ষই ‘পর্দার পিছনে’ তৃণমূলের সঙ্গে আছে। সিপিএমকে ভোট দেওয়া মানে তৃণমূলকেই সাহায্য করা বলে মন্তব্য করে বিজেপির পক্ষেই সব ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। সিপিএম ও কংগ্রেস পাল্টা বলেছে, তাদের জোট যে বিজেপি ও তৃণমূলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে, প্রথমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও এখন মোদীর বক্তব্যেই তা স্পষ্ট!
সপ্তম দফায় রাজ্যে ভোট রয়েছে দুই ২৪ পরগনা ও কলকাতা মিলিয়ে মোট ৯টি কেন্দ্রে। তার আগে মঙ্গলবার বারাসাত ও বসিরহাট কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থী স্বপন মজুমদার ও রেখা পাত্রের সমর্থনে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে এবং যাদবপুরের প্রার্থী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সমর্থনে বারুইপুরে জোড়া সমাবেশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দুই সভাতেই তৃণমূলের পাশাপাশিই তাঁর তির ছিল সিপিএম ও কংগ্রেসের দিকে। অশোকনগরে মোদী বলেছেন, ‘‘সিপিএমকে ভোট দিলে তৃণমূলের খাতায় যাবে! পর্দার পেছনে তৃণমূল এবং বামেরা মুদ্রার এ পিঠ-ও পিঠ। মুখ্যমন্ত্রীও বলে দিয়েছেন, দিল্লিতে এদেরকে সহযোগিতা করবেন। এই জন্য পর্দার পিছনে যে খেলা চলছে, পশ্চিমবঙ্গেও জনগণ তা বন্ধ করে দেবেন।’’ বারুইপুরেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘সিপিএম এবং তৃণমূলের দোকান এক। দোকানে সামগ্রী এক। দু’পক্ষই ‘ইন্ডিয়া’ জোটে আছে। দু’পক্ষই তোলাবাজি করেছে। দু’পক্ষই গণতন্ত্র-বিরোধী।’’ তৃণমূলের আগে কংগ্রেস এবং বামেরা বাংলাকে ‘লুট’ করেছে বলেও অভিযোগ করেছেন মোদী।
ভোটের প্রচারে তৃণমূল নেত্রী মমতা নিয়মিতই বলছেন, বাংলায় সিপিএম ও কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া মানে বিজেপিকে জিততে সাহায্য করা। সেই প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়েই মোদীকে জবাব দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক ও পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। সেলিমের বক্তব্য, ‘‘ভোট যত শেষের দিকে যাচ্ছে, মোদী ও মমতার নিশানা এবং বক্তব্য এক হয়ে যাচ্ছে! দু’জনেই সিপিএমকে আক্রমণ করছেন। এক জন বলছেন, সিপিএমকে ভোট দেওয়া মানে বিজেপিকে দেওয়া। অন্য জন বলছেন, সিপিএমকে ভোট দেওয়া মানে তৃণমূলকে দেওয়া তার মানে বোঝা যাচ্ছে, সিপিএমকে নিয়ে দু’জনেই খুব চিন্তিত। ওঁদের খেলা ধরা পড়ে যাচ্ছে!’’
অধীরের কথায়, ‘‘প্রচারের নামে এখন মোদী-খেউড় চলছে! তাঁর এই সব কথায় বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেস ও বামের জোট উদীয়মান শক্তি। জোটের সমর্থন বাড়ছে, তাতে কোথাও মোদীর, কোথাও দিদির ঘট উল্টোবে! মেরুকরণের মরিয়া চেষ্টায় তাঁরা বাম, কংগ্রেসকে আক্রমণ করছেন।’’ কয়েক দিন আগেই কর্মজীবনের মেয়াদ তিন মাস বাড়ানো হয়েছে রাজ্যের মুখ্যসচিব বি পি গোপালিকার। কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি ছাড়া যে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হত না, তা উল্লেখ করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির সংযোজন, ‘‘এখান থেকেও বোঝা যাচ্ছে, দিদি দু’দিকেই ইট পেতে রাখছেন!’’
দুর্নীতি, তোলাবাজি, তোষণের রাজনীতির অভিযোগে চেনা সুরেই এ দিন তৃণমূলকে আক্রমণ করেছেন মোদী। সেই সঙ্গেই আদালতের রায় সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর নানা মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘‘আদালতের নির্দেশের পরে মুখ্যমন্ত্রী কী কী বলছেন, শুনে আমি তো হয়রান হয়ে যাচ্ছি! বিচারকদের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন। তৃণমূলের নেতাদের কাছে জানতে চাই, বিচারকদের পিছনেও কি আপনাদের গুন্ডা ছেড়ে দেবেন?’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘কেউ যদি তৃণমূলের দুর্নীতি সামনে আনে, তৃণমূল তাকেই নিশানা করে।’’
পাল্টা আক্রমণ করে তৃণমূলের আইনজীবী-নেতা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এ দেশে বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস যদি কেউ নড়িয়ে দিয়ে থাকেন, তিনি মোদী। কর্তব্যরত বিচারপতির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে দলের প্রার্থী হিসেবে ভোটে নামিয়ে দিয়েছেন। তার পরেও এই কথা বলতে বাধছে না!’’ উদাহরণ হিসেবে তিনি সিঙ্গুর মামলার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট সেই রায়দান প্রক্রিয়া পিছিয়ে দিয়েছিল। কারণ, মাসকয়েকের মধ্যে রাজ্যে নির্বাচন ছিল। সেই নির্বাচনে রায়ের প্রভাব এড়াতে তখন এটা করা হলেও এখন ২০১২ সালের মামলা টেনে এনে নির্বাচনের আগে রায় দেওয়া হচ্ছে! এ সব ইতিহাসে নথিবদ্ধ হয়ে থাকবে।’’
বাংলার বেহাল শিল্প-চিত্রের কথা তুলেও তৃণমূল এবং বাম-কংগ্রেসের সমালোচনা শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘স্বাধীনতার আগে একটা সময় ছিল, যখন বাংলা আয়পত্তর দিত লক্ষ দেশবাসীকে। বাংলায় বেশির ভাগ কল-কারখানা আজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখানকার বেশির ভাগ যুবকেরা পালিয়ে যাচ্ছে। বাংলার এই হাল কে করেছে? আগে বাংলায় কংগ্রেস লুট করেছে। তার পরে বামেরা। এখন তৃণমূল দু’হাতে লুট করছে! কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল তিন জনেই দোষী।’’ প্রধানমন্ত্রীর সংযোজন, ‘‘বাইরে বেরিয়ে ১০০ জনকে জিজ্ঞেস করলে ৯০ জন বলবে, মোদী সরকার আসছে। যখন নিশ্চিত মোদী সরকার হবে, ভোট নষ্ট করবেন কেন?’’