(বাঁ দিকে) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাজনাথ সিংহ (মাঝে)। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন রাজনাথ সিংহ! কিন্তু এখন প্রধানমন্ত্রী মোদীকে সকাল-বিকেল প্রণাম করে তিনি নিজের গদি টিকিয়ে রাখছেন। বুধবার আবারও কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে কটাক্ষ করলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গেই উস্কে দিলেন বিজেপির ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব’-এর জল্পনা। যেখানে প্রায়ই শোনা যায় মোদীর দ্বারা রাজনাথ সিংহ, নিতিন গডকরীদের কোণঠাসা হওয়ার গুঞ্জন। তবে কটাক্ষ করলেও মমতা মন্তব্য করেন যে, বাংলায় এসে রাজনাথ যে ভাবে তাঁর সরকারকে আক্রমণ করেছেন, তা তিনি আশা করেননি।
সোমবার চাকুলিয়ার সভা থেকে রাজনাথকে বিঁধেছিলেন মমতা। বুধবার বর্ধমান-দুর্গাপুরের গলসির সভা থেকেও একই রকম ভাবে তিনি তীব্র আক্রমণ করেন প্রবীণ বিজেপি নেতাকে। বললেন, রাজনাথ প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে কারও কোনও আপত্তি থাকত না। কিন্তু এখন সেই রাজনাথই মোদীর সামনে মাথা নত করে নিজের গদি বাঁচিয়ে চলেছেন। মমতার কথায়, ‘‘মোদীর দয়ায় তো বেঁচে থাকেন! সকাল-বিকেল মোদীকে প্রণাম করে চেয়ার বাঁচান। আপনিও তো দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন! কেউ তো বারণ করেননি।’’ এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণমন্ত্রী নিতিনের নামও তুলে এনেছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘নিতিনও হতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী। আপত্তি ছিল না। একটা ভদ্রলোক যান!’’ এর পর মমতা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘‘যাঁরা দাঙ্গা করেন, যাঁদের হাতগুলো লাল, তাঁরা হয়েছেন (প্রধানমন্ত্রী)।’’
মনে করা হচ্ছে, এ ভাবে আসলে বিজেপির ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব’কেই উস্কে দিতে চেয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হন মোদী। তার পর থেকেই দলে ‘কোন্দল’ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। প্রবীণদের একাংশ বার বার মোদী-অমিত শাহের দিকে আঙুল তুলতে থাকেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার অভিযোগ করেন তাঁরা। দলে রাজনাথ, নিতিনের মতো প্রবীণ নেতাদের কোণঠাসা হওয়ার অভিযোগও ওঠে। সেই ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব’কেই বুধবার আরও এক বার উস্কে দিলেন মমতা। এর আগেও মোদীর বিকল্প হিসাবে রাজনাথের নাম করেছেন তিনি বার বার। ২০১৬ সালের শেষে নোট বাতিলের পরেও রাজনাথের নাম নেতা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন মমতা। প্রধানমন্ত্রী মোদীকে সরিয়ে বিজেপির অন্য কোনও নেতাকে সামনে রেখে কেন্দ্রে সরকার গড়ার দাবি তুলেছিলেন তিনি। রাজনাথ-সহ আরও কয়েক জন নেতারও নাম করেছিলেন । এ বার সেই প্রসঙ্গই আবার খুঁচিয়ে তুললেন মমতা।
রবিবার মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির নরসিংহপুরে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী গৌরীশঙ্কর ঘোষের সমর্থনে প্রচারে এসে রাজনাথ বলেছিলেন, ‘‘পৃথিবীর কোনও শক্তি ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হওয়া আটকাতে পারবে না।’’ সন্দেশখালিকাণ্ডের উল্লেখ করে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে সুর চড়িয়েছিলেন রাজনাথ। মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং শিলিগুড়ির সভা থেকে মমতাকে কটাক্ষ বলেছিলেন, ‘‘নামই মমতা, স্বভাবে মমত্ব নেই।’’ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, সোমবার উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ার প্রচারসভা থেকে রাজনাথকে পাল্টা কটাক্ষ করেন তৃণমূলনেত্রী। বুধবার আবার একই সুরে রাজনাথকে বিঁধলেন মমতা।
জলঙ্গির সভায় রাজনাথ বলেছিলেন, ‘‘এক বার আমাদের ভোটে জেতান, তার পরে দেখছি, কে, কতটা মায়ের দুধ খেয়েছে, যে সন্দেশখালির মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।’’ সেই মন্তব্যের বুধবার তীব্র নিন্দা করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘কাগজে দেখেছি। ক্ষমা করবেন, এটা আমার ভাষা নয়। আমার উচ্চারণ করতেও লজ্জা করছে।’’ তার পরেই মমতা এ-ও জানান যে, রাজনাথের থেকে তিনি এ রকম আশা করেননি। প্রসঙ্গত, মমতা যখন এনডিএ জোটে ছিলেন, তখন থেকেই রাজনাথের সঙ্গে তাঁর ‘সুসম্পর্ক’। তিনি এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরেও সেই সম্পর্ক রয়ে গিয়েছিল। প্রথম দফার মোদী সরকারে রাজনাথ ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রাজনৈতিক মহলে এমন একটি ধারণাও তৈরি হয়েছিল সে সময় যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রাজনাথ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি বহু ক্ষেত্রে ‘নরম’ মনোভাব নিয়েছেন। এর আগে বাংলায় সভা করতে এসেও মমতাকে কখনও কটাক্ষ করেননি রাজনাথ। সেই নিয়ে বিজেপির নীচুতলার কর্মীদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ ছিল। এমনকি, সারদা-নারদকাণ্ড নিয়েও নয়। ২০১৭ সালে রাজ্যে কর্মিসভা করতে এসে কলকাতায় এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। ওই সারদা-নারদ কাণ্ডে তদন্ত নিয়ে প্রশ্নের জবাবে রাজনাথ বলেছিলেন, ‘‘আইন আইনের কাজ করবে। বিজেপি সরকার অন্য সরকারের মতো এ সব বিষয়ে নাক গলায় না।’’ তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলার ‘অবনতি’র প্রশ্নের জবাবে শুধুই বলেছিলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়।’’ সেই রাজনাথই ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে যখন মমতাকে আক্রমণ করেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই মমতা বলেন, ‘‘রাজনাথের মতো মানুষের থেকে আমি আশা করিনি।’’