মুর্শিদাবাদে প্রচারে মহম্মদ সেলিম। — নিজস্ব চিত্র।
হয় তৃণমূল কংগ্রেস, না হয় বিজেপি! বাংলার রাজনীতি মানেই এখন এই দুই মেরুর তরজা। এই দ্বিমেরু ভাষ্যে ছেদ নিয়ে আসাই এ বারের লোকসভা নির্বাচনে বাম শিবিরের লক্ষ্য। প্রবীণ নেতা বিমান বসু থেকে দীপ্সিতা ধর, সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো একগুচ্ছ তরুণ প্রার্থী দৌড়চ্ছেন এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই।
কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে এ বারই প্রথম বাংলায় লোকসভা ভোটে লড়ছে বামফ্রন্ট। রাজ্যে মোট ৩০ আসনে বাম প্রার্থী রয়েছেন। তার মধ্যে মুর্শিদাবাদে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং দমদমে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী অভিজ্ঞ মুখ। বাকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ময়দানে নামানো হয়েছে তরুণ প্রজন্মকে। সেলিম ও সুজন নিজেদের কেন্দ্রে প্রচারে ব্যস্ত থাকায় কেন্দ্রীয় ভাবে দলের কাজকর্ম আপাতত সামলাচ্ছেন বর্ষীয়ান নেতা বিমান, সূর্যকান্ত মিশ্রেরা। সিপিএম সূত্রের খবর, কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসক দলের সঙ্গে আর্থিক ক্ষমতায় এঁটে ওঠার বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বেশির ভাগ এলাকাতেই এখনও পর্যন্ত বাম প্রার্থীদের প্রচারে ভাল সাড়া মেলার রিপোর্ট এসেছে। লোকসভা ভোট ঘোষণার দু’মাস আগে সিপিএমের যুব সংগঠনের ডাকে ব্রিগেড সমাবেশেও চোখে পড়ার মতো ভিড় হয়েছিল। কিন্তু ভিড় হলেও ভোটে তার ফল মিলবে কি না, সেই প্রশ্ন ভাবাচ্ছে সিপিএমকে। বিমানবাবুরা পরামর্শ দিচ্ছেন, এ বারের ভোট-প্রক্রিয়া লম্বা সময় ধরে চলবে। তার মধ্যে অনেক কিছু উঠে আসবে, ভেসে চলেও যাবে। ময়দানে পড়ে থেকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
রুটি-রুজি, কর্মসংস্থানের প্রশ্নকেই এই লড়াইয়ের মূল মন্ত্র হিসেবে সামনে রেখেছে সিপিএম। দ্বিমেরু তত্ত্বের বাইরে বেরোতে এই বিকল্প ভাষ্যই তাদের অস্ত্র। বিমানবাবু বলছেন, ‘‘কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে যে লড়াইয়ের পরিকল্পনা আমরা করেছি, তার মুখ্য উদ্দেশ্য বিজেপি এবং তৃণমূলের দ্বিমেরু রাজনীতিকে ভাঙা। সেটা যদি আমরা পারি এবং জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তা হলে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে কী কী হতে পারে, এখনই হিসেব করা যায় না। সেই হিসেব করছিও না।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সেলিমেরও একই সুর, ‘‘নির্বাচনী বন্ডের দুর্নীতির পরিণাম মানুষের জীবনে কী, এখন দেখা যাচ্ছে। উপঢৌকনের ফলে পরিকাঠামো দুর্বল হয়েছে। এক দিকে দুর্নীতি ও দুষ্কৃতী-রাজের প্রতিবাদ এবং অন্য দিকে সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আমরা লড়ছি। রুটি-রুজি এবং মানুষের জীবনের জরুরি বিষয়গুলিকে নিয়েই দ্বিমেরু ভাষ্যকে ভাঙতে চাই।’’
বামেদের তরুণ প্রার্থীদের দাবি, প্রচারে বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁদের এই বক্তব্য এখন পৌঁছচ্ছে। তমলুকের সিপিএম প্রার্থী, তরুণ আইনজীবী সায়নের দাবি, ‘‘বিজেপি এবং তৃণমূল নিজেদের স্বার্থে এই দ্বিমেরু রাজনীতি চালিয়ে যেতে চায়। আমরা ২০২১ সালের ভোটেও এটা বলেছিলাম, এখন মানুষ নিজেরাই বুঝছেন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘বিজেপি ও তৃণমূলের মাঝে বামপন্থীদের জায়গা নিতে হবে বিকল্পের কথা বলে, রুটি-রুজির প্রশ্ন তুলে। লড়াই কঠিন কিন্তু দল যে দায়িত্ব দিয়েছে, আমি এবং আমার সহযোদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে তা-ই পালন করছি।’’ প্রচার-পর্বে অন্তত আলোচনায় উঠে এসেছেন শ্রীরামপুরের প্রার্থী দীপ্সিতা। তাঁরও মতে, ‘‘সেই ২০২১ থেকে এই ২০২৪ পর্যন্ত একটা সপ্তাহও যায়নি, যখন আমরা রাস্তায় ছিলাম না। কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই সরকার আমাদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। মানুষের জন্য ন্যায়-বিচার আদায়ে যে লড়াই, মানুষ তা দেখেছেন, মানুষই অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।’’
বিজেপি ও তৃণমূল শিবির থেকে কটাক্ষ আসছে, জয়ের সম্ভাবনা নেই বুঝেই বামেরা এক ঝাঁক তরুণ মুখকে ময়দানে ঠেলে দিয়েছে! যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্যের পাল্টা মন্তব্য, ‘‘আগে বলা হত বৃদ্ধতন্ত্র! নরেন্দ্র মোদীর সাদা চুল-দাড়িতে আপত্তি নেই কিন্তু বিমান বসুর সাদা চুলে আপত্তি! তরুণ প্রজন্মের হাতে ব্যাটন যাওয়া আমাদের দলে স্বাভাবিক ও নীরব প্রক্রিয়া। তবে আসল বিষয়টা হল কোন রাজনীতির কথা আমরা বলছি।’’ দ্বিমেরু ভাঙতে অভিজ্ঞ ও তরুণ সৈনিকেরা যেখানে লড়ছেন, গত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের পরিসংখ্যানের বিচারে তার প্রায় সবই যে শক্ত আসন, তা-ও তো সত্যি? বিমানবাবু অবশ্য উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন, ‘ঘাঁটি’ বলে চিরকাল কিছু হয় না। মানুষের মন বদলালে সবই পরিবর্তনীয়! যে কারণে কলকাতা দক্ষিণেও সায়রা শাহ হালিমের লড়াই অভাবনীয় ফল দিতে পারে বলে তাঁর বিশ্বাস।