—ফাইল চিত্র।
রাজপুতদের রাজ্য। কিন্তু রাজস্থানের ভোটের সুতো এ বার শাসকগোত্রীয় রাজপুতদের হাতে ছিল না। ছিল ‘শাসিত’ জাঠেদের হাতে। গত কয়েক বছর ধরেই একটু একটু করে তপ্ত হচ্ছিলেন রাজস্থানের জাঠেরা। ২০২৩ সালের বিধানসভা ভোটের পর সেই তাপের চাপে ভোটবাক্সের একাংশে ‘মরুভূমি’ হতে দেখেছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। বিপদ বুঝে দিল্লি থেকে রাজস্থানে ছুটে এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহেরা। প্রয়োগ করেছিলেন সফল হওয়ার বাছাই ব্রহ্মাস্ত্র। তাতে যে শেষ পর্যন্ত খুব একটা কাজ হয়নি তার প্রমাণ দিল লোকসভা ভোটের ফলাফল।
যে রাজপুতদের রাজ্য গত দু’টি লোকসভায় 'ফুলমার্কস' অর্থাৎ ২৫টি আসনের মধ্যে ২৫টিই পেয়ে এসেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ, সেই রাজস্থানে এই লোকসভায় ভোটে বিজেপি এসে ঠেকল ১৪ আসনে। তাদের পুরনো জোটসঙ্গী আরএলপি পেয়েছে ১টি। আর অন্য দিকে, বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার শরিক সিপিএম ১টি আসন পেয়ে খাতা খুলেছে এ রাজ্যে। আর গত দুই লোকসভায় রাজস্থানে শূন্য পাওয়া কংগ্রেস পেয়েছে ৮টি আসন। অর্থাৎ হিসাব দাঁড়াল এনডিএ ১৫, ইন্ডিয়া ন’টি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যে রাজস্থান এক বছর আগেও বিজেপিকে রাজ্যের শাসক হিসেবে বিজেপিকে বেছে নিয়েছে রাজস্থান, সেখানে এমন পাশা বদলের কারণ কী? রাজনীতিবিদদের একাংশের মতে রাজস্থানে জাত্যাভিমানের কাছেই আসন খুইয়েছে পদ্ম।
নামেই রাজপুতদের রাজ্য। জাতির নিরিখে আদতে রাজস্থানে সংখ্যাধিক্য জাঠেদেরই। উত্তর-পশ্চিমের এ রাজ্যে জাঠ ভোটার ১২ শতাংশ। হিসাব বলছে, সংখ্যায় ৬৫ লক্ষের কিছু বেশি তাঁরা। বিভিন্ন জাতির মধ্যে তাঁরাই সর্বোচ্চ। অর্থাৎ জয়-পরাজয়ের হিসাব বদলানোর জন্য যথেষ্ট। তুলনায় রাজপুত ভোট কম। সংখ্যায় মোট ভোটারের ৯ শতাংশ। এ ছাড়া আছেন গুর্জরেরা। এঁরাও সংখ্যায় রাজপুতদের সমান— ৯ শতাংশ। ‘জাত-কাতর’ রাজস্থানে নতুন লড়তে নামা রাজনৈতিক দলও এই হিসাব জানে এবং মানে। বিজেপির না জানার কথা নয়। কিন্তু তার পরেও ২০২৩ সালের বিধানসভা ভোটে জয়ে পদ্ম দূরে ঠেলেছিল জাঠেদের প্রিয় নেত্রী বসুন্ধরা রাজে শিন্ডেকে।
হোক রাজপুতদের রাজ্য। রাজস্থানের রাজবধূ এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা জানতেন, জাতিবাদ তাঁর রাজ্যে কী বিষম বস্তু! তাই নিজে রাজপুত রাজার কন্যা হলেও সেই পরিচয় নিয়ে বড়াই করতেন না। বরং বলতেন, ‘‘আমি রাজপুতের কন্যা, জাঠেদের বৌমা আর গুর্জর আমার সম্বন্ধী।’’ প্রকৃতপক্ষেই তিনি তা-ই। ফলে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেছে নিলে রাজস্থানের জাত রাজনীতি হাতের মুঠোয় থাকত বিজেপির। কিন্তু তা হয়নি। বিধানসভা নির্বাচনে রাজস্থান জয়ের পর বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেছে নেয় রাজস্থানের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ভজনলাল শর্মাকে। রাজপুতদের তুষ্ট রাখতে উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ দেওয়া হয় রাজস্থানের রাজকুমারী দিয়া কুমারীকে। বড় পদে বঞ্চিত থেকে যান জাঠ-গুর্জরেরা।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তবু রাজপুতদেরই রাজ্য। তাই তাঁদের মতামতেই গুরুত্ব দিয়েছিল পদ্ম। বসুন্ধরাকে মসনদ না দেওয়ার নেপথ্যে কাজ করেছিল দু’টি সমীকরণ। তার মধ্যে প্রথমটিই ছিল রাজপুত। ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটের আগে স্বজাতি-কন্যা বসুন্ধরার উপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন রাজপুতেরা। রাজস্থানে তাঁদের শীর্ষ সংগঠন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিজেপি-বিরোধী ভোট দেবেন। বসুন্ধরার জন্য মাসুল গুনেছিল বিজেপি। রাজস্থান জয় করেছিল কংগ্রেস। ২০২৩ সালে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চায়নি পদ্ম। তবে নিন্দকেরা বলেছিলেন, এটা আসলে বাইরের কারণ। বসুন্ধরাকে রাজস্থানের ক্ষমতা না দেওয়ার নেপথ্যে কাজ করেছিল দ্বিতীয় সমীকরণটিই। সেটি হল বসুন্ধরার ‘মোদী বিরোধিতা’। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বহু বার মোদীর সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধ হয়েছে বসুন্ধরার। সেই ‘অবাধ্যতা’রই শাস্তি পান তিনি। কিন্তু ২০২৪ সালের ভোট সমীকরণ গোড়া থেকেই জানিয়েছিল, রাজস্থানে ‘মোদী ম্যাজিক’ উধাও! রাজপুতের রাজ্যে ভোট হবে জাতি প্রাধান্যের ভিত্তিতেই। কার্যক্ষেত্রে হয়েছেও তাই।
রাজপুতদের রাজ্যে যুদ্ধগাথার ছড়াছড়ি। রাজ্যের ২৫টি লোকসভা কেন্দ্রের যুদ্ধেও জয়-পরাজয়ের কাহিনি বদলেছে। ২০০৯ সালে ২০টি আসনই পেয়েছিল কংগ্রেস। চারটি বিজেপি। পরের বার ২০১৪ সালের কংগ্রেস-বিরোধী ঝড়ে আবার ২৫টি আসনই এসে পড়েছিল পদ্মবনে। চার বছর পরে রাজস্থানের বিধানসভায় জয়ী হয় কংগ্রেস। ফলে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তায় ছিল বিজেপি। কিন্তু রাজস্থানে সে বারেও পদ্মঝড় ওঠে। ২৫-এর মধ্যে ২৪টি আসনই ছিনিয়ে নিয়ে যায় বিজেপি। তবে বিশেষজ্ঞেরা বলেন, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে উরি-পুলওয়ামা পরবর্তী ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বড় ভূমিকা পালন করেছিল। সীমান্তবর্তী এবং যোদ্ধা রাজপুতদের রাজ্য রাজস্থানে তার প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ২০২৩ সালের বিধানসভা ভোটের ফলে কিছু হিসাব গুলিয়ে যায়।
রাজপুতদের রাজ্যে জাঠেরা শক্তিশালী। এই জাঠেরা মূলত কৃষক শ্রেণিভুক্ত। ২০২০-’২১ সালে যখন দেশে কৃষকবিক্ষোভ চলছে, তখন রাজস্থানের কৃষক বা জাঠেদের একাংশও যোগ দিয়েছিলেন তাতে। যদিও কেন্দ্রবিরোধী মনোভাবের সেই প্রভাব ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জাঠ ভোটে বিশেষ পড়েনি। পড়লে বিজেপির জয় সহজ হত না। কিন্তু বসুন্ধরা পর্বের পরে এই জাঠেরাই বিজেপি বিরোধী হয়ে ওঠেন। ২০২৪ সালের কৃষক আন্দোলনে জোরালো হয় তাঁদের যোগদান। জাঠেদের প্রিয় নেত্রী বসুন্ধরাও লোকসভা ভোটের প্রচার থেকে গুটিয়ে নেন নিজেকে। লোকসভা ভোটে তিনি মন দেন কেবল পুত্র দুষ্মন্ত সিংহের কেন্দ্রে। অন্য দিকে, গুর্জর নেতা সচিন পাইলটের সুবাদে রাজস্থানের গুর্জর ভোট কংগ্রেসের দিকে রয়েছে গত কয়েক দশক ধরেই। এর মধ্যেই রাজস্থানের ভোটদানের হার নতুন করে চিন্তায় ফেলে মোদীদের।
রাজপুতদের রাজ্যে এ বার ভোট দিতেই যাননি অনেকে। ২০১৯ সালের তুলনায় ভোটদানের হার কমেছে ৪.৬২ শতাংশ। দু’দফায় ভোট ছিল রাজস্থানে। প্রথম দফায় গত বারের তুলনায় ৫.৮৫ শতাংশ কমেছিল ভোটদানের হার। তাতে প্রমাদ গোনেন মোদী-শাহেরা। দ্বিতীয় দফার ভোটের আগে প্রথম সারির নেতাদের রাজস্থানে পাঠায় পদ্ম। মোদী, শাহ, নড্ডা, যোগী— কে ছিলেন না সেই তালিকায়! জাতি ভোটে বিপদ রয়েছে আন্দাজ করেই এই সব বিজেপি নেতা রাজস্থানে মেরুকরণের প্রচার শুরু করেন।
রাজপুত রাজ্যে হিন্দু ভোট ৮৯ শতাংশ। মুসলিম ৯ শতাংশ। মোদীরা তাই রামমন্দির থেকে শুরু করে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের মতো বিষয়কে নতুন করে তুলে ধরেন রাজস্থানে। বিজেপি একটা সময়ে রাজস্থানে কতটা বিপন্ন বোধ করছিল, তা বোঝা যায় শাহের এক সাক্ষাৎকারে। ভোটদানের হার কমার প্রসঙ্গে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, রাজস্থানে এ বার কিছু আসন হাতছাড়া হতে পারে বিজেপির। অন্য দিকে, কংগ্রেসের পাইলট এবং অশোক গহলৌতেরা দাবি করেন, কংগ্রেস এ বারের দশের বেশি আসন পাবে রাজস্থানের লোকসভা ভোটে। সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে না মিললেও কাছাকাছি গেল কংগ্রেস।
রাজপুতরা যোদ্ধা। তবে ইতিহাসবিদদের একাংশ বলছেন, ‘রাজপুত’ বলে আলাদা কোনও শ্রেণি ছিল না রাজস্থানে। রাজস্থানে যে সমস্ত সম্প্রদায় রয়েছে, তাদেরই একাংশ ক্ষমতা হাতে পেয়ে নিজেদের শাসক বলে ঘোষণা করে। নাম নেয় রাজপুত। অর্থাৎ, নাম না থাক, যুদ্ধের মুনশিয়ানা কমবেশি ছিল রাজপুতানার সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই। সেই অর্থে রাজপুতানার সকলেই রাজপুত। স্বভাবযোদ্ধা। যারা বহু অপমানের জবাব দিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে, সেই রাজপুত যে কৃষক আন্দোলন, সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদ না পাওয়ার ক্ষোভ এবং অন্যান্য অবজ্ঞার জবাবও ভোট যুদ্ধে দেবে, তা কাঙ্খিত ছিল। ‘রাজপুতানা’ নিরাশ করেনি।