(বাঁ দিক থেকে) অধীর চৌধুরী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মল্লিকার্জুন খড়্গে। —ফাইল চিত্র।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে কড়া বার্তা দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে। দু’ঘণ্টার মধ্যে দলের সর্বোচ্চ পদাধিকারীকে পাল্টা বার্তা দিলেন বিদায়ী লোকসভার কংগ্রেস দলনেতা অধীর। এবং বুঝিয়ে দিলেন, খড়্গেরা যা-ই বলুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূলের বিরোধিতায় তিনি রাশ টানবেন না। এই বার্তা দিতে গিয়ে অধীর মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনিও ‘হাইকমান্ডের লোক’।
অধীরের উদ্দেশে খড়্গে শনিবার বলেন, ‘‘হয় হাইকমান্ডের কথা মানতে হবে, তাদের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে হবে, না হলে বাইরে যেতে হবে।’’ এবং এ-ও বলেছেন, ভোটের পর সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কী হবে না হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধীর চৌধুরী কেউ নন। সেটা ঠিক করবে হাইকমান্ড। এই বক্তব্যের অব্যবহিত পরেই অধীর আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘আমিও কংগ্রেসের সিডব্লিউসি (কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি) মেম্বার। আমিও হাইকমান্ডের লোক।’’ তার পর এ নিয়ে বহরমপুর কংগ্রেস দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করেন অধীর। সেখানেই তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেসকে কেউ খতম করবে, আমি তাঁকে খাতির করব, তা তো হতে পারে না। দলের সৈনিক হিসেবে এই লড়াই আমি থামাতে পারব না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমার বিরোধিতা নৈতিক বিরোধিতা। আমার বিরোধিতায় কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই। পশ্চিমবঙ্গে আমার পার্টি রক্ষা করার লড়াই করছি।’’
রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, খড়্গের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংঘাতে নেমে পড়লেন অধীর। যে বার্তা দিয়ে খড়্গে অধীরকে হয়তো চুপ করাতে চেয়েছিলেন, ৬৮ বছরের কংগ্রেস নেতা তাতে আরও সুর চড়ালেন। খড়্গে-অধীর এই সংঘাত থামাতে সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীরা হস্তক্ষেপ করেন কি না তা নিয়েও কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
শনিবার লখনউয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র নেতারা। সেখানেই মমতার বক্তব্য, তার পাল্টা অধীরের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে খড়্গে মমতার পাশেই শুধু দাঁড়াননি, নিজের দলীয় সতীর্থকে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। খড়্গে বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে বাইরে থেকে সমর্থনের কথা বলেছিলেন। বাইরে থেকে সমর্থন কোনও নতুন বিষয় নয়। প্রথম ইউপিএ সরকারে বামেরাও বাইরে থেকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তার পরেও মমতার আরও একটি বিবৃতি এসেছে। যাতে স্পষ্ট যে, তিনি ‘ইন্ডিয়া’য় আছেন এবং সরকার গঠিত হলে তিনি তাতে শামিল হবেন।’’
গত বুধবার মমতার করা মন্তব্য নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর বলেছিলেন, ‘‘উনি (মমতা) জোট থেকে পালিয়ে গিয়েছেন। ওঁর কোনও কথায় আমি ভরসা করি না। এখন দেখছেন হাওয়া বদলাচ্ছে। তাই এ দিকে ভিড়তে চাইছেন। বিজেপির দিকে পাল্লা ভারী দেখলে ও দিকে যাবেন।’’ এ নিয়ে খড়্গে বলেছেন, ‘‘অধীর চৌধুরী ঠিক করার কেউ নন। কী হবে তা ঠিক করার জন্য আমরা রয়েছি। কংগ্রেস পার্টি রয়েছে। হাইকমান্ড রয়েছে। হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবে। হয় সেই সিদ্ধান্ত মানতে হবে, না হলে বাইরে চলে যেতে হবে।’’
লোকসভা ভোটে বাংলায় এক বারই এসেছিলেন খড়্গে। মালদহের সেই সভা থেকে তিনি মমতাকে আক্রমণও শানিয়েছিলেন। অধীরদের সুরে এ-ও বলেছিলেন, ‘‘বিজেপি যেমন দেশকে কংগ্রেসমুক্ত করতে চেয়েছে, তেমন তৃণমূলও বাংলাকে কংগ্রেসমুক্ত করতে চেয়েছে।’’ রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, রাজ্যের বাস্তবতা এবং সর্বভারতীয় সমীকরণ ভিন্ন। সে কারণই খড়্গে শনিবার অধীরের উদ্দেশে ওই কথা বলেছেন। যেমন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, দিল্লির জোটে তিনি আছেন, কিন্তু বাংলায় বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে তিনি নেই। বাংলায় বাম-কংগ্রেস যেমন তৃণমূলকে বিজেপির পরিপূরক বলছে, তেমন মমতারও বক্তব্য, রাজ্যে সিপিএম–কংগ্রেস কাজ করছে বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে।
লোকসভা ভোটের আগে যখন বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে জোটের বার্তা দিচ্ছিলেন জয়রাম রমেশের মতো সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতারা, সেই সময়েও অধীর তৃণমূল বিরোধিতা জারি রেখেছিলেন। যা নিয়ে এক বার জয়রাম বলেছিলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা ‘ইন্ডিয়া’র শরিক মনে করি। আর অধীরজির মতো তৃণমূলেরও অনেকে নানান মন্তব্য করেছেন। ওগুলো বড় বিষয় নয়। এটা দেশ বাঁচানোর লড়াই।’’ সেই সময়ে অধীরকে কোনও কড়া বার্তা দেননি সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতারা। কিন্তু চার দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পরে অধীরের অবস্থানকে নস্যাৎ করে দিলেন খড়্গে। ঘটনাচক্রে, এমন সময় খড়্গে অধীরকে এই তিরস্কার করলেন, যখন বাংলায় কংগ্রেসের শক্ত জায়গায় (মালদহ, মুর্শিদাবাদ) ভোট সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে।