—ফাইল চিত্র।
ভোটগ্রহণ পর্ব মেটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলার নানা প্রান্তে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সংঘর্ষ। সোমবার, ভোটের ফলপ্রকাশের এক দিন আগেও জারি রইল সেই পরিবেশ। উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, হুগলির ধনিয়াখালি থেকে বীরভূমের দুবরাজপুর— অশান্তি এবং আতঙ্কের ছবি ধরা পড়ল দিকে দিকে। এই প্রেক্ষিতে আগামী ১৯ জুন পর্যন্ত বাংলায় ৪০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। অন্য দিকে, লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের আগে শান্তির বার্তা দিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস।
ভোটের আগে থেকেই উত্তেজনা ছিল ভাঙড়ে। ভোট শেষেও সেই পরিবেশই বজায় রয়েছে। সোমবার দুই তৃণমূল কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে আইএসএফের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি একাধিক তৃণমূল কর্মীকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে নওশাদ সিদ্দিকির দলের বিরুদ্ধে। ভাঙড়ের উত্তর কাশীপুর থানার মাঝেরহাট এলাকায় এই ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছে আইএসএফ। উল্টে রাজ্যের শাসকদলের দিকে আঙুল তুলেছে তারা।
নির্বাচনের আগের দিনই তাজা বোমা উদ্ধার হয়েছে বীরভূমের দুবরাজপুরে। লোবা গ্রাম পঞ্চায়েতের বরারি গ্রামের কাছে অজয় নদে বালিতে পোঁতা অবস্থায় প্লাস্টিকের বস্তাভর্তি ২৫টি তাজা বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। খবর দেওয়া হয় সিআইডি এবং বম্ব ডিসপোজ়াল টিমকে। সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, মঙ্গলবার ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর সন্ত্রাস ছড়াবে না তো এলাকায়! মুর্শিদাবাদের রানিনগর এলাকার একটি পাটক্ষেতে প্লাস্টিকের বালতি থেকে বস্তাভর্তি প্রচুর সকেট বোমা উদ্ধার হয়। পুলিশ বোমাগুলি উদ্ধার করেছে। বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোটগণনার আগে এলাকায় সন্ত্রাস ছড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন বাম-কংগ্রেস কর্মীরা। জোট কর্মীদের বিরুদ্ধে পাল্টা একই অভিযোগ করেছে শাসকদলও। ভোটের ফলের আগে বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় শোরগোল হয়েছে হুগলির ধনিয়াখালিতেও।
ভোট পরবর্তী ‘হিংসা’র অভিযোগ উঠেছে সন্দেশখালিতে। রবিবার রাতের অন্ধকারে বেশ কয়েক জন বিজেপি কর্মী-সমর্থকের বাড়িতে ঢুকে হামলার অভিযোগ উঠেছে সন্দেশখালির খুলনায়। মারধর করা হয় বিজেপি কর্মীর স্ত্রীকেও। খুলনার বাসিন্দা সঞ্জীব মণ্ডল এবং তাঁর স্ত্রী পিয়ালি মণ্ডলের অভিযোগ, অন্তত ৫০ জন লোকের একটি দল তাঁদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। মারধরের পর তাঁদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। সঞ্জীবের দাবি, কেন তাঁরা বিজেপি করেন, তার জবাব চায় ওই দল। ওই দম্পতি ইতিমধ্যে এ নিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন সোমবার। সন্দেশখালির পুলিশ সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। ভোটের আগের রাতে রাজ্যের যত্রতত্র ছোট ছোট গন্ডগোলের খবর মিলেছে। ভোটের ফলের দিন এবং তার অব্যবহিত পরে যাতে কোনও অশান্তি না-হয়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ করছে প্রশাসন।
রাজনৈতিক সংঘর্ষ নিয়ে নির্বাচন কমিশন
ফল প্রকাশের আগের দিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার। তিনি জানান ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে। রাজীব জানান, আগামী ১৯ জুন পর্যন্ত বাংলায় ৪০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। যদিও তিনি আশাবাদী যে, হিংসা হবে না। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কথায়, ‘‘আমাদের মনে হয় না যে, ভোট পরবর্তী হিংসা হবে। কিন্তু যদি তা হয়, সে ক্ষেত্রে ভোটের ফলের পরেও মোতায়েন থাকছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। তবে কেন্দ্রীয় বাহিনী তখন থাকবে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তখন রাজ্যের উপরে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, মণিপুরে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকবে। আমাদের ধারণা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্যে ভোট পরবর্তী হিংসা বন্ধ করা যাবে।’’
ফল ঘোষণার আগে বার্তা রাজ্যপালের
নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের পরে বাংলায় হিংসার আশঙ্কা করে আগেভাগে বার্তা দিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। সোমবার সন্ধ্যায় রাজ্যপাল সকলের উদ্দেশে বলেন, “ফলাফল স্পষ্ট হওয়ার পর সমাজবিরোধী-গ্যাংস্টাররা সুযোগ নিতে পারে। সকলে সতর্ক থাকবেন। যা ফল হবে, তা মেনে নেবেন।”
ভোট শেষে ভয়ঙ্কর ঘটনা
শেষ দফার ভোট হয়েছিল শনিবার। আর সেই সন্ধ্যায় নিজের বাড়ির কাছেই খুন হন নদিয়ার পচা চাঁদপুরের রেললাইন পাড়ার বাসিন্দা হাফিজুর শেখ। ৩৫ বছরের হাফিজুরের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও তাঁকে নিজেদের দলের কর্মী বলে দাবি করে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তোলে বিজেপি। এই ঘটনায় শাসকদলের বিরুদ্ধে ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’র অভিযোগ তুলে সব বিরোধী পক্ষই সরব হয়েছে। শুধু নদিয়াই নয়, উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরেও সন্ত্রাস ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। শনিবার রাতে পর পর বোমা বিস্ফোরণে তপ্ত হয় ভাটপাড়া এবং নৈহাটি। ভোটের পর থেকে সন্দেশখালির কিছু জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। অন্য দিকে, কলকাতা উত্তরের বিজেপি প্রার্থী তাপস রায়ের পোলিং এজেন্টকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শাসকদল অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ভোটের পর বাংলার নানা স্থানে অশান্তির ঘটনা নিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের অভিযোগ, ‘‘ভোট শেষ হতেই রাজ্য জুড়ে লাগামছাড়া সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। আমাদের কর্মীদের বাড়ি-ঘর ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভোটে হারবে জেনেই তৃণমূল এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।’’