মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মালা রায়ের প্রচারে গিয়ে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের প্রশংসা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার বেহালা চৌরাস্তায় একটি জনসভার মঞ্চ বেহালায় মেট্রোরেল স্থাপনে প্রাক্তন মেয়র শোভনের প্রশংসা করেন মমতা। যদিও তাঁর প্রিয় ‘কাননের’ নাম নেননি তিনি।
তার পর থেকেই বেহালা তথা দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূলে জল্পনা শুরু হয়েছে তৃণমূলে শোভনের ‘প্রত্যাবর্তন’ নিয়ে। এমন প্রশ্নও ঘুরছে যে, ভোট মিটলেই শোভনকে দলে ফিরিয়ে বেহালার রাজনীতির দায়িত্ব দেবেন মমতা? পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারির পর ‘অভিভাবকহীন’ বেহালায় তৃণমূলে নেতৃত্বের সঙ্কট চলছে। জল্পনা যে, সেই সঙ্কট কাটাতে ‘দিদি’ আবার তাঁর প্রিয় কাননের উপর আস্থা রাখতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে বেহালা পূর্বের বিধায়ক তথা শোভনের ‘বিচ্ছিন্না’ স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘অভিভাবকত্ব’ মানবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
নির্বাচনী সভায় বেহালার মেট্রো প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মমতা বলেন, ‘‘এক জনকে আমি যদি থ্যাঙ্কস না দিই, তা হলে আমি ভুল করব। সে হয়তো আজ ডাইরেক্টলি (সরাসরি) তৃণমূল কংগ্রেস করে না। সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু তখন সে মেয়র ছিল।’’ মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘কোন কোন স্পটে স্টেশন হবে, সেই জমি পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনকি, সেই সময় নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে রেলস্টেশন তৈরি করার ব্যবস্থা হয়েছিল।’’ তাঁর এমন মন্তব্যের পরই জল্পনা শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে দিল্লিতে বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন শোভন। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে তালমিল না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সক্রিয় হননি যুগলে। আপাতত তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে। মাঝে এক বার তৃণমূলে ফেরার জল্পনা তৈরি হলেও তা জল্পনাই থেকে গিয়েছে। সে কারণেই শোভনের তৃণমূলে ফেরার সম্ভাবনা সকলেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। একটা সময়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ কলকাতার রাজনীতি কার্যত শোভনের ‘চোখ’ দিয়েই দেখতেন মমতা। তাই ২০১০ সালে তৃণমূল দ্বিতীয় বার কলকাতা পুরসভা দখল করার পরে শোভনকে মেয়র পদে বসিয়েছিলেন তিনি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর তাঁকে একাধিক দফতরের মন্ত্রীও করেন। কিন্তু ‘ব্যক্তিগত’ কারণে ২০১৮ সালে মেয়র-সহ মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন শোভন। নিজের বেহালার বাড়ি ছেড়ে গোল পার্কের আবাসনে থাকতে শুরু করেন বৈশাখীকে নিয়ে। স্ত্রী রত্নার সঙ্গে এখন তাঁর বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে।
২০১৯ সালের ভাইফোঁটার সময় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কালীঘাটে ভাইফোঁটা নিতে গেলে শোভনের তৃণমূলে ফেরার জল্পনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর ছেড়ে যাওয়া আসন বেহালা পূর্বে স্ত্রী রত্নাকে তৃণমূল প্রার্থী করায় দলে ফিরতে চাননি শোভন।
শোভন-জায়া রত্না এখন বেহালা পূর্বের বিধায়ক হওয়ার পাশাপাশি কলকাতা পুরসভার ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলরও বটে। ঘটনাচক্রে, ওই ওয়ার্ড থেকে জিতেই কলকাতার মেয়র হয়েছিলেন শোভন। দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলেও বিধানসভা নির্বাচনের পর আর তাঁকে তৃণমূল-বিরোধী কোনও মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। মমতার সঙ্গেও তাঁর ‘ব্যক্তিগত’ পর্যায়ে যোগাযোগ আছে বলেই শোভনের ঘনিষ্ঠদের দাবি।
১৯৮৫ সালে ২১ বছর বয়সে কলকাতা পুরসভার ১৩২ নং ওয়ার্ড থেকে কংগ্রেসের প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন শোভন। সেই ভোটে জিতে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ২০০০ সালে তৃণমূলে যোগ দিয়ে ওই ওয়ার্ড থেকে জিতে কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (জল সরবরাহ) হয়েছিলেন তিনি। সেই থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে তিনি ‘জল-শোভন’ বলে পরিচিত। ২০১০ সালের নির্বাচনে ১৩২ নম্বর ওয়ার্ডটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হলে পর্ণশ্রী এলাকার বাড়ির ১৩১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রার্থী হয়ে জিতে মেয়র হন শোভন। সে বার ১৩২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে শোভন তৃণমূল প্রার্থী করেন সঞ্চিতা মিত্রকে। সেই থেকে পর পর তিন বার ওই ওয়ার্ডে জিতেছেন তিনি।
শোভনের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে সেই সঞ্চিতা বলছেন, ‘‘আমরা দিদিকে দেখে দল করি। দিদির নির্দেশ আমাদের কাছে শিরোধার্য। দিদি যদি আমাদের শোভনদাকে নিয়ে কাজ করতে বলেন, তা হলে আমাদের সেই নির্দেশ মানতে হবে।’’ দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক তথা বেহালার বাসিন্দা শঙ্কর ঘোষের কথায়, ‘‘শোভন আমাদের পুরনো দিনের সঙ্গী। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। দল যদি চায় শোভন ফিরে আসুক, তা হলে আমরা সেই নির্দেশ মেনে নেব। কারণ, আমরা দলের সৈনিক। সৈনিকদের দলের নির্দেশ মেনেই কাজ করতে হয়।’’